মিনিটের পর মিনিট পেরিয়ে যাচ্ছে। নিচু স্বরে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত বিচারপতি আর কে অগ্রবাল ও বিচারপতি অভয়মোহন সাপ্রে। এক জন কিছু বলছেন, আর এক জন তার পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন। রাজ্য বিজেপি ও পশ্চিমবঙ্গের আইনজীবীরা ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন।
দীর্ঘ ক্ষণ পরে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি জানালেন, পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে তাঁরা সোমবারই রায় শোনাবেন। সোমবারই মনোনয়ন জমার শেষ দিন। বিজেপি নেতৃত্বের আশা, সুপ্রিম কোর্ট সেই সময়সীমা বাড়িয়ে দেবে।
দলের প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিতে পারছেন না, এই অভিযোগ তুলে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল রাজ্য বিজেপি। দাবি ছিল, মনোনয়ন জমার সময়সীমা বাড়ানো হোক। কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানো হোক। সেই মামলায় আজ পঞ্চায়েত ভোটের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই-ই উঠে এল সুপ্রিম কোর্টের এজলাসে। আগ বাড়িয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকার খোলাখুলি বিজেপির পাশেই দাঁড়াল।
কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানো নিয়ে রাজ্য বিরোধিতা করার আগেই, এমনকী আদালত কেন্দ্রের বক্তব্য জানতে চাওয়ার আগেই মোদী সরকারের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল তুষার মেটা জানিয়ে দেন— রাজ্য নির্বাচন কমিশন চাইলে বাহিনী দিয়ে সাহায্য করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা কেন্দ্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
আরও পড়ুন: মনোনয়ন সুষ্ঠু করতে বলল কোর্ট
বিজেপির হয়ে মুকুল রোহতগি আজ দাবি করেন, পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের হত্যাকাণ্ড চলছে। কোনও বিরোধী দলকেই মনোনয়ন জমা দিতে দেওয়া হচ্ছে না। বীরভূম, বর্ধমানের মনোনয়ন জমার হিসেব তুলে ধরে রোহতগি বলেন, তৃণমূলের যেখানে দেড় হাজারের কাছাকাছি গ্রাম পঞ্চায়েতে মনোনয়ন জমা পড়েছে, সেখানে বিজেপির সংখ্যাটা ১২০-র আশেপাশে। কংগ্রেস, সিপিএমের সংখ্যাটা আরও কম।
পাল্টা আক্রমণে গিয়ে রাজ্যের আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি বলেন, উনি নিজের গোলেই বল ঢোকাচ্ছেন। কারণ ওই পরিসংখ্যানই বলছে, আলিপুরদুয়ার, উত্তর দিনাজপুর, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরে বিজেপির মনোনয়ন জমার সংখ্যা তৃণমূলের থেকে বেশি। শাসক দল বাধা দিলে তা কী ভাবে সম্ভব! বিজেপির পিটিশনে, কখন, কোথায়, কাকে বাধা দেওয়া হয়েছে, তার কোনও তথ্য নেই। বিজেপি নিজেই কম প্রার্থী দিচ্ছে না, তার প্রমাণ কী!
বিজেপির আর্জি খারিজ করার দাবিতে একেবারে রাজনৈতিক আক্রমণে গিয়ে মনু সিঙ্ঘভি বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে অশান্তি চলছে ঠিকই। অশান্তি তৈরি করছে বিজেপি। কারণ তাঁদের উপস্থিতি শূন্য। তাই অশান্তি তৈরি করছে।’’
দুই দুঁদে আইনজীবীর এই টানটান লড়াইয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বার বার নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করতে হয়েছে দুই বিচারপতিকে। রাজ্যে লাগামছাড়া হিংসার অভিযোগ তুলে রোহতগি বলেন, শাসক দলের তাণ্ডবে বিজেপি ও কংগ্রেস এখন এক বিন্দুতে। কংগ্রেস হাইকোর্টের দ্বারস্থ। বিজেপি সুপ্রিম কোর্টে। মার খাচ্ছে সিপিএমও। বিডিও অফিসে গেলেই বাধা আসছে, মারধর চলছে। বাঁকুড়ায় বিজেপি প্রার্থী অজিত মুর্মুর খুনের উদাহরণ তুলে ধরেন রোহতগি। হিংসার ছবি দেখান। বিজেপির আর এক আইনজীবী পি এস পাটওয়ালিয়া যুক্তি দেন, একমাত্র সমাধান হল মনোনয়ন জমার সময়সীমা বাড়ানো এবং অনলাইনে মনোনয়ন জমার ব্যবস্থা করা। মনু সিঙ্ঘভি যুক্তি দেন, মনোনয়নে বাধা আসার অভিযোগ পেয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যেই বিডিও দফতরের পাশাপাশি এসডিও দফতরে মনোনয়নের ব্যবস্থা করেছে। রাজ্য পুলিশও যে নিষ্ক্রিয় নয়, তার প্রমাণ— ২৮টি এফআইআর দায়ের হয়েছে। পাটওয়ালিয়া বলেন, এ থেকেই স্পষ্ট বিরোধীদের অভিযোগ সত্য। হামলা এসডিও দফতরের বাইরেও হতে পারে।
বিচারপতি সাপ্রে প্রশ্ন তুলেছিলেন, রাজ্য বিজেপি কেন কলকাতা হাইকোর্টে যাচ্ছে না। রোহতগি জানান, হাইকোর্টে দু’মাস ধরে আইনজীবীদের ধর্মঘট চলছে। সংবিধান সংশোধন করেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল। সেই পঞ্চায়েতের ভোট অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে সুপ্রিম কোর্ট আগেও হস্তক্ষেপ করেছে। মনু সিঙ্ঘভি প্রশ্ন তোলেন, যদি কেউ বাধা পেয়ে থাকেন, তা হলে তিনি সুপ্রিম কোর্টে আসুন। দল হিসেবে বিজেপি কী করে আদালতের দ্বারস্থ হয়!