মন্তেশ্বর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তারের অপেক্ষায় রোগীরা।
সে বহু বছর আগের কথা। ঘন জঙ্গল কেটে তৈরি হয়েছিল জনপদ। শোনা যায়, রায়গড়ের (বর্তমানে রায়গ্রাম) সামন্ত রাও এ তল্লাটে মন্টেশ্বর শিবলিঙ্গ স্থাপন করেছিলেন। শিবকুণ্ডু নামে দিঘিও খনন করেছিলেন। সেই থেকেই না কি এ শহরের নাম মন্তেশ্বর।
কালনা মহকুমার পাঁচ ব্লকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা এ ব্লকেই। ১৩টি পঞ্চায়েতে চার লক্ষেরও বেশি মানুষ বসবাস করেন। তাঁদের বেশিরভাগই কৃষিজীবি। কিন্তু এত মানুষের রোজকার প্রয়োজনের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোই বেহাল এ ব্লকে। সরকারি ক্ষেত্র তো বটেই বেসরকারি ক্ষেত্রের হালও তথৈবচ।
এত বড় ব্লকে কোথাও গ্রামীণ হাসপাতাল নেই। রয়েছে একমাত্র ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সেখানেও আবার বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের অভাব, কর্মীর অভাব লেগেই রয়েছে। ফলে সামান্য রোগব্যাধিতেই ছুটতে হয় ৩৫ কিলোমিটার দূরের বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অথবা ৫০ কিলোমিটার দূরের কালনা মহকুমা হাসপাতালে। তবে আঁধার নামার পরে সে পথেও মুশকিল। অ্যাম্বুল্যান্স বা গাড়ি জোগাড় করা রীতিমতো ঝক্কির। এককথায় ঘরে কারও রোগব্যাধি হলেই আতঙ্কে ভোগেন বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, জটিল রোগে হাসপাতাল ছুটতে ছুটতেই মরণ ঘনিয়ে আসে রোগীর।
মন্তেশ্বর স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির উপর ব্লকের মানুষ ছাড়াও কাটোয়ার একাংশ রোগীরাও নির্ভরশীল। স্বাস্থ্যকেন্দ্র সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতিদিনই বর্হিবিভাগে শ’দেড়েক রোগীর ভিড় থাকে। আর চিকিত্সক মাত্র চার জন। তাঁদের কেউই আবার বিশেষজ্ঞ নন। তার মধ্যে কেউ ছুটিতে থাকেন, কেউ বদলি হয়ে গেলে নতুন চিকিত্সক আসতে আসতে হয়রান হয়ে যান রোগীরা। দুদর্শা চরমে ওঠে। ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নার্স, গ্রুপ ডি এবং সাফাই কর্মীদের সংখ্যাও অপ্রতুল। মাত্র ৩০টি ওয়ার্ডে এত বাসিন্দার চাপ সামলানো যায় না অভিযোগ ওঠে প্রায়শই। তার উপর প্রসূতীদের সিজারের কোনও ব্যবস্থা নেই ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ফলে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা প্রসূতিদের সিজার করার প্রয়োজন হলেই পত্রপাঠ রেফার করে দেওয়া হয় অন্য হাসপাতালে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অন্যত্র যেতে যেতে অবস্থা আরও সঙ্গিন হয়ে পড়ে। কখনও কখনও পথেই প্রসব হয়ে যায়। এ ছাড়া দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত, হৃদযন্ত্রের গোলমাল বা অন্য কোনও জটিল রোগেও রোগীদের ভবিতব্য সেই জেলা অথবা মহকুমা হাসপাতাল। হাসপাতাল নিয়ে অভিযোগ রয়েছে আরও। যেমন, শিশুদের জন্য আলাদা কোনও বিভাগ নেই। জেনারেটরের কোনও ব্যবস্থা নেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তরফে বহুকাল আগে একটা ইনভার্টার কেনা হয়েছিল। কিন্তু তা-ও শুধু স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভেতরের অংশেই আলো দেয়। লোডশেডিংয়ে বাইরের চারপাশ আঁধারই রয়ে যায়। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কোনও সীমানা পাঁচিল নেই। ফলে গরু, ছাগল, শুয়োর চড়ে বেড়ায় যত্রতত্র। ব্লকের চাষিদের অভিযোগ, এখনও কোনও ন্যায্য মূল্যের ওষুদের দোকান গড়ে ওঠে নি। সরকারি ব্যবস্থায় প্যথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি না থাকায় বাইরে থেকে চড়া দামে সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়।
স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বেআব্রু দশা অজানা নয় সরকারি আধিকারিক বা জনপ্রতিনিধিদের। জেলা সভাধিপতি দেবু টুডু ও সাংসদ মমতাজ সঙ্ঘমিতা ঘুরেও গিয়েছেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। নানা সমস্যার কথাও খোঁজ নিয়েছেন। মন্তেশ্বর পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য সজল পাঁজা বলেন, “সাংসদের কাছে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিকাঠামো উন্নত করতে ৬০ লক্ষ টাকা চাওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ৪৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দও করা হয়েছে। শীঘ্রই কাজ শুরু করা হবে।” মন্তেশ্বরের বিএমওএইচ চন্দন ঘোষের দাবি, “জেলার অন্য ব্লকের তুলনায় সবথেকে বেশি ডেলিভারি হয়েছে এই ব্লকে।” তাঁর দাবি, “সাংসদ কোটার টাকায় দ্বিতল মাতৃভবন ও সীমানা পাঁচিলের একাংশ গড়া হবে। ইতিমধ্যেই চিকিত্সকদের একটা তালিকা বেরিয়েছে। আমরা আশাবাদী, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য নতুন চিকিত্সক পাব।”
ময়নামপুরেও ভেঙে পড়ছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশাপাশি ধন্যখেরু, পুরশুড়ি ও ময়নামপুরে একটি করে স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। একসময় এলাকার মানুষের ভরসা জোগালেও বর্তমানে তিনটিরই পরিকাঠামো ভেঙে পড়েছে। কোনওটিতেই চিকিত্সক নেই। অযত্নে ভেঙে পড়তে চলছে ভবনগুলিও। মন্তেশ্বর-মেমারি রোডের পাশে বিঘে দশেক জমির উপর তৈরি ময়নামপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্র ঘুরে দেখা গিয়েছে, কয়েকটি ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। বাসিন্দারা জানান, বছর দশেক আগেও নিয়মিত চিকিত্সক মিলত। ছোটখাটো অস্ত্রোপচারও হতো। ময়নামপুর ছাড়াও আশপাশের কাটশিহি, ঢেউচাঁদা, ইচু ইত্যাদি ২০টি গ্রামের বাসিন্দারা আসতেন এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। স্থানীয় বাসিন্দা রাজেশ মণ্ডল জানান, কয়েক বছর আগে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ট্রান্সফর্মার চুরি যায়। তারপর থেকেই রাতে আলো জ্বলে না। রবিবার ও ছুটির দিন ছাড়া দেখা মেলে এক ফার্মাসিস্ট ও এক নার্সের। বাসিন্দাদের দাবি, জ্বরের ট্যাবলেট ছাড়া কিছু মেলে না ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
১৯৫২ সালে স্থাপিত ধান্যখেরু স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি সবচেয়ে প্রাচীন। বছর দুয়েক আগে ৫৫ লক্ষ টাকা খরচ করে চিকিত্সক ভবন, অপারেশন থিয়েটার, শিশুবিভাগ ইত্যাদি গড়া হয়। বাসিন্দারা জানান, বছর চারেক আগেও বহু রোগীই পরিষেবা পেতেন। বেশ কিছু অস্ত্রোপচারও হতো। কিন্তু বছর খানেক আগে দুই চিকিত্সককে তুলে নেওয়া হয়। তারপর থেকে পরিষেবাও প্রহসনে পরিণত হয়। নতুন ভবনের উদ্বোধন হয়নি বলেও স্থানীয়দের দাবি। গ্রামের গৌর দাস, কৌশিক দাসেরা জানান, ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। রাতে রোগীদের দুর্ভোগের সীমা থাকে না।
এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির করুণ দশায় চাপ আরও বাড়ছে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সরকারি পরিকাঠামোর অভাব আরও প্রকট হচ্ছে। তবে বেসরকারি ক্ষেত্রেও কমবেশি একই ছবি মন্তেশ্বরে। সেখানেও চিকিত্সকের আকাল, অস্ত্রোপচার করাতে মুশকিল, অ্যাম্বুল্যান্সের চড়া ভাড়া এ সব সঙ্গী সাধারণ মানুষের।
ছবি: মধুমিতা মজুমদার।
(চলবে)