কল্যাণপুরের স্কুলে চলছে বৈঠক।—নিজস্ব চিত্র।
প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলে গ্রামবাসীদের সঙ্গে প্রায় রাতভর বৈঠক করে তাঁদের নানা সমস্যার কথা শুনলেন জেলা প্রশাসনের আধিকারিকরা। কিছু সমস্যা মিটল বৈঠকেই, কিছু সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হল।
সোমবার রাতে কালনা ২ ব্লকের কল্যাণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওই বৈঠক হয়। স্কুল ভবনেই রাত কাটান আধিকারিকেরা। তবে আগাম বার্তা ছাড়া প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে প্রশাসনের আধিকারিকদের সাধারণ মানুষের সমস্যা শোনা নতুন নয়। কখনও জেলাশাসক বিভিন্ন দফতরের আধিকারিকদের নিয়ে রাতের বৈঠকে হাজির হয়েছেন, কখনও জেলা সভাধিপতি হাজির থেকেছেন। বৈঠক করেছেন বিডিও, মহকুমাশাসকেরাও। এ দিন জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন ও জেলা সভাধিপতি দেবু টুডু এক সঙ্গে একটি বড় প্রশাসনিক দল নিয়ে কল্যাণপুরে আসেন। সঙ্গে ছিলেন দুই অতিরিক্ত জেলাশাসক প্রণব বিশাস ও হৃষিকেশ মুদি, কালনার মহকুমাশাসক সব্যসাচী ঘোষ, কালনা ২-এর বিডিও গৌরাঙ্গ ঘোষ, কালনা ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আলমগীর সাত্তার এবং বিদ্যুত্ ও প্রাণিসম্পদ দফতরের ব্লক পর্যায়ের একাধিক আধিকারিক। কালনা ২ ব্লকের কৃষি মেলার উদ্বোধন করে প্রশাসনিক দলটি সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ ওই গ্রামে পৌঁছয়। দলটি গ্রামে ঢুকতেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে একটি আদিবাসী নাচের দল অতিথিদের বরণ করেন। আগে থেকেই স্কুলটির ভিতর আধিকারিকদের বসার জন্য কাপড়ের মঞ্চ বেঁধে রাখা হয়েছিল।
বৈঠকের শুরুতেই দেবুবাবু তাঁদের গ্রামে আসার কারণ জানিয়ে দেন গ্রামবাসীদের। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাদর, কম্বল গায়ে গ্রামবাসীদের প্রশ্নও বাড়তে থাকে। ওই পঞ্চায়েতের বাসাই গ্রামের বাসিন্দা তাপস মণ্ডল জেলাশাসককে জানান, তাঁদের গ্রামে বেহুলা নদীর উপর সেতুর ভগ্নদশা। সেটি কবে মেরামতি করা হবে তাও জানতে চান তিনি। জেলাশাসক দ্রুত সমস্যাটি লিখিত ভাবে বিডিও-কে জানাতে বলেন। কল্যাণপুর গ্রামের অর্জুন দে নিজ গৃহ, নিজ ভূমি প্রকল্পে ঘর তৈরি করে দেওয়ার আবেদন করেন। আধিকারিকেরা তাঁকে, পঞ্চায়েতে ওই আবেদন জানাতে বলেন। ৮০ বছরের বৃদ্ধা মামনি মাঝি জানান, তাঁর ঘর ভেঙে গিয়েছে। শীতে কষ্ট পাচ্ছেন তিনি। প্রশাসনের কাছে সাহায্যেরও আর্জি জানান। বৃদ্ধার কথা শুনে জেলাশাসক ২৯ জানুয়ারি তাঁকে বিডিও-র সঙ্গে দেখা করতে বলেন। অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধেও। গ্রামবাসীরা দাবি করেন, এলাকায় দেদার মোটরবাইক ধরে ফাইন করা হচ্ছে। এক যুবক দাবি করেন, পাসপোর্ট করাতে গেলে ঘুষ চাওয়া হচ্ছে। না দিলে পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজকর্ম আটকে রাখা হচ্ছে। বিষয়টি দেখার আশ্বাস দেন আধিকারিকেরা। জিউধারা এলাকার শঙ্কর দে আবার গ্রামে পানীয় জলের সমস্যার কথা বলেন। তিনি জানান, রাহাতপুর, কেলনই, সর্বমঙ্গলা প্রভৃতি গ্রামে জনস্বাস্থ্য কারিগরী দফতরের কোনও জলপ্রকল্প নেই। উঠে আসে পাকা রাস্তা, মোরাম রাস্তা তৈরি, এলাকায় পোস্ট অফিস চালু, ইন্টারনেট পরিষেবা চালু, রেশন কার্ড, আধার কার্ড না মেলার মতো বেশ কিছু সমস্যাও। জেলা সভাপতি দেবু টুডু বলেন, “জামিরতলা থেকে বাসাই গ্রাম পর্যন্ত একটি রাস্তা গড়তে চলেছে জেলা পরিষদ। খুব দ্রুত সাড়ে তিন কিলোমিটার ওই রাস্তার কাজ শুরু হবে।” এলাকার একটি সমবায় সমিতি জানায়, তাদের প্রায় ৩৩ লক্ষ টাকা বিদ্যুত্ বিল এসেছে, যা অস্বাভাবিক। এরপরেই জেলাশাসকের নির্দেশে বিদ্যুত্ দফতরের আধিকারিকরা বিষয়টি দেখেন। তাঁরা ঘটনাস্থলেই জানিয়ে দেন, কোনও ভাবে ভুল বিল পাঠানো হয়েছে। অবিলম্বে সঠিক বিল পাঠানো হবে। রাত প্রায় দশটা পর্যন্ত চলে প্রশ্নোত্তর পর্ব।
বৈঠক শেষে আধিকারিকদের জন্য রাতে থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল স্কুল ভবনেই। মেনু ছিল, ভাত, ডাল, এঁচড়ের তরকারি, মুরগির মাংস, পাঁপড়, চাটনি এবং মিষ্টি। মঙ্গলবার ভোরে প্রশাসনিক দলটি ফিরতি পথে রওনা দেয়। দুপুরে কালনার মহকুমাশাসক সব্যসাচী ঘোষ জানান, ২৯ জানুয়ারি কল্যাণপুর পঞ্চায়েত ভবনে একটি প্রশাসনিক ক্যাম্প করা হবে। সেখানেও বেশ কিছু সমস্যা মেটানো হবে। জেলা সভাধিপতি বলেন, “এই ধরনের সভাগুলিতে যেমন গ্রামের মানুষের নানা সমস্যা মেটানো যাচ্ছে, তেমনি প্রশাসনও নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছে।”