শহরের স্মৃতিতে পাহাড়ে হারানো প্রিয়জন

ছন্দা গায়েনের জন্য গোটা বাংলার সঙ্গেই প্রার্থনা করছে আসানসোল। সেই সঙ্গেই আসানসোলবাসীর স্মরণে আসছে ঘরের ছেলেদের এই ধরনের দুর্ঘটনায় পড়ার স্মৃতি। দুর্গম শৃঙ্গ জয়ের টানে নানা সময়েই রুকস্যাক কাঁধে ছুটে গিয়েছেন এই শহরের অনেকে। কিন্তু তার মধ্যে ফিরে আসেননি সাত জন।

Advertisement

নীলোৎপল রায়চৌধুরী

আসানসোল শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৪ ০০:৫৮
Share:

বেশ কিছু দিন আগে শহরে এসেছিলেন ছন্দা। নিখোঁজ হওয়ার পরে প্রার্থনা তাঁর জন্য।—নিজস্ব চিত্র।

ছন্দা গায়েনের জন্য গোটা বাংলার সঙ্গেই প্রার্থনা করছে আসানসোল। সেই সঙ্গেই আসানসোলবাসীর স্মরণে আসছে ঘরের ছেলেদের এই ধরনের দুর্ঘটনায় পড়ার স্মৃতি।

Advertisement

দুর্গম শৃঙ্গ জয়ের টানে নানা সময়েই রুকস্যাক কাঁধে ছুটে গিয়েছেন এই শহরের অনেকে। কিন্তু তার মধ্যে ফিরে আসেননি সাত জন। কেউ পা হড়কে, কেউ বা তুষারঝড়ে পড়ে তলিয়ে গিয়েছেন বরফের নীচে। ছন্দার জন্য প্রার্থনার মাঝেই সে কথা মনে করছে আসানসোলের পর্বতারোহীরা।

শহরের পর্বত অভিযাত্রীদের সবথেকে পুরনো সংস্থা মাউন্টেন লাভার্স অ্যাসোসিয়েশন (এমএলএ) সূত্রে জানা গিয়েছে, তাদের উদ্যোগে ১৯৮২ সালের ১৫ অগস্ট ২৫,৬৪৫ ফুট উঁচু নন্দাদেবী শৃঙ্গ অভিযানে ৬ জন শেরপা-সহ ১৬ জনের একটি দল রওনা হয়েছিল। অভিযাত্রীদের প্রত্যেকেই ছিল আসানসোলের বাসিন্দা। কিন্তু তাঁরা নন্দাদেবী জয় করতে পারেনি। দলের সদস্য বাদল দত্তগুপ্ত বেসক্যাম্প থেকে ৪ নম্বর ক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছান। তারপর আর এগোতে না পেরে তিনি ৩ নম্বর ক্যাম্পে নামার সময় পা হড়কে বরফের মধ্যে তলিয়ে যান। দিন কয়েক পরে বরফের নীচে থেকে বাদলবাবুর মৃতদেহ উদ্ধার হয়। ওই অভিযানেই প্রাণ হারান আর এক অভিযাত্রী অমলেশ সেনগুপ্ত। ৩ নম্বর ক্যাম্প থেকে ২ নম্বর ক্যাম্পে নামার সময়ে পা হড়কে তলিয়ে যান অমলেশবাবু। পড়ে যান জলদ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক অভিযাত্রীও। জলদবাবু প্রাণে বেঁচে গেলেও পাহাড়ের কোলেই মৃত্যু হয় অমলেশবাবু।

Advertisement

পরের দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৮৮ সালে। শহরের পর্বত অভিযাত্রীরা জানাচ্ছেন, ইসিএল অনুমোদিত পর্বত অভিযাত্রী সংস্থা কোলফিল্ড ক্লাইম্বার সার্কেলের উদ্যোগে গঙ্গোত্রী (২) অভিযানে গিয়েছিলেন পাণ্ডবেশ্বরের অজয় মণ্ডল, আসানসোলের ঘাঁটিগলির নবারুণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়। শৃঙ্গ জয় করে নীচে নামার সময়ে দু’জন পোর্টার-সহ অভিযাত্রীরা তুষারঝড়ে আটকে পড়েন। তার পরে পাহাড়ের কোলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সবাই। বাকি অভিযাত্রীদের মৃতদেহ মিললেও নবারুণবাবুর দেহ পাওয়া যায়নি। নবারুণবাবুর দাদা গৌরব বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন দাদা। ১৪ দিন পরে বাড়িতে খবর আসে, দাদারা তুষার ঝড়ে আটকে পড়েছেন। উদ্ধারের জন্য টাকা প্রয়োজন। গৌরববাবুর দাবি, “সরকার পাহাড়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দেয়। কিন্তু অভিযাত্রীরা বিপদে পড়লে তাঁদের উদ্ধারে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে সরকারকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।”

২০০২ সালে গঙ্গোত্রী (৩) যাত্রায় গিয়ে মৃত্যু হয় আসানসোলের আপকার গার্ডেনের (পশ্চিম) গৌতম মুখোপাধ্যায় ও বুধা গ্রামের তপন দাঁ-র। আসানসোলের পর্বত অভিযাত্রীদের মতে, ওই অভিযাত্রী দলে ১০ জন ছিলেন। দলের ৮ জন সদস্য বেসক্যাম্পে থেকে গেলেও গৌতমবাবু ও তপনবাবু শৃঙ্গ জয় করতে যান। তখনই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েন তাঁরা। গৌতমবাবুর স্ত্রী মিতালিদেবী জানান, দলের ৮ জন সদস্য বেসক্যাম্পে ছিল। ওঁরা দু’জন সামিট করতে যাচ্ছিলেন। অসুস্থ থাকার কারণে তপনবাবু সামিট ক্যাম্পে আটকে যান। এক জন পোর্টারকে নিয়ে গৌতম সামিট ক্যাম্পে পৌঁছন। তার পরে শুরু হয় তুষারঝড়। টানা আট দিন সামিট ক্যাম্পে আটকে ছিলেন তাঁরা। তার মধ্যে পোর্টার নীচে নেমে আসেন। বেসক্যাম্প থেকে বাকিরাও নেমে যান। তিনি বলেন, “বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারি, তুষারঝড় থামার পরে সামিট ক্যাম্প থেকে অসুস্থ তপনবাবুকে কাঁধে নিয়ে গৌতম নীচে নামতে শুরু করে। তার মধ্যেই আবার তুষারঝড় শুরু হয়। দু’জনেই বরফ চাপা পড়েন। ১৯ ফুট বরফের তলা থেকে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার হয়।” তাঁর খেদ, “বেসক্যাম্প থেকে বাকিরা নীচে নেমে না এলে হয়তো দু’টো প্রাণ অকালে ঝরে যেত না।”

এভারেস্ট ও লোৎসে জয় করার পরে ছন্দা গায়েনকে ২০১৩ সালের নভেম্বরে আসানসোল জেলা গ্রন্থাগারে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন আসানসোলের মাউন্টেন লাভার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যেরা। অনুষ্ঠানে ছিলেন আসানসোলের মেয়র তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “গত মাসেও কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযান নিয়ে আমার সঙ্গে ছন্দার ফোনে কথা হয়েছিল। আমি এখনও বিশ্বাস করি, ছন্দা বেঁচে রয়েছে।” ছন্দাকে জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা কমে আসলেও সেই আশা এখনই ছাড়তে নারাজ পিকার্সের কর্তা মিলন সেনগুপ্ত, আসানসোলের পর্বতারোহী রাজু পণ্ডিতেরা। দাদা অমলেশ সেনগুপ্তকে হারিয়েও পাহাড়ের নেশা ছাড়তে পারেননি মিলনবাবু। তাঁদের কথায়, “পাহাড়ে চড়া রোমাঞ্চকর অনুভূতি। তাই ঝুঁকি নিয়েও মানুষ পাহাড়ে যায়। এর পরেও যাবে। তবে ছন্দা ফিরে এলে আমাদের মনের জোর অনেকটা বেড়ে যাবে।”

প্রিয়জনকে হারানোর যন্ত্রণা ভুলতে মনের জোরই যে সবচেয়ে বড় রসদ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement