কথিত আছে এই দালানেই দুর্গাপুজো করেছিলেন ভাস্কর পণ্ডিত।
‘বারো ঘাট, তেরো হাট, এই নিয়ে দাঁইহাট।’
প্রবাদ থেকেই বোঝা যায়, শুরু থেকেই বাণিজ্য নগরী হিসেবে নাম ছিল এ তল্লাটের। মুঘল, বাংলার নবাবের হাত ঘুরে বর্ধমানের রাজাদের অধীনে আসে এ জনপদ। নানা সৌধ, মন্দিরে শোভা বাড়ে শহরের। কাঁসা-পিতলের ব্যবসায় ভর করে লক্ষ্মীও অচলা রয়ে যান। কিন্তু বিধি বাম। সে সময়েই বর্গি হামলায় তছনছ হয়ে যায় এ শহর। ইতিহাস বলে, ভাস্কর পণ্ডিতের সৈন্যরা সৌধ ভেঙে, সম্পদ নষ্ট করে ছিনিয়ে নেয় এ জনপদের গৌরব। থমকে পড়া শুরু সেই থেকেই। যমজ শহর কাটোয়া এগিয়ে এলেও কি জনসংখ্যা, কি পুর-পরিষেবাদাঁইহাট পুরসভা রয়ে গিয়েছে নামেই।
আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে যে ইন্দ্রাণী পরগণার উল্লেখ পাওয়া যায় তা গড়ে উঠেছিল এই দাঁইহাটকে ঘিরেই। ইতিহাস বলে, মুঘল আমলেও সমৃদ্ধ এ অঞ্চল থেকে মোটা অঙ্কের রাজস্ব যেত। পরে মুর্শিদকুলি খাঁয়ের আমলে দাঁইহাটের হাতবদল হয়। বাংলার নবাব দায়িত্ব নেন এ জনপদের। ভাগীরথীকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্য অবশ্য চলছিলই। আরও পরে নবাব সুজাউদ্দিনের সময়ে পাটুলির জমিদার রামভদ্র চৌধুরীকে দায়িত্ব দেন নবাব। ১৭২৮ সালে বর্ধমানের রাজা চিত্রসেনের অধিকারে আসে দাঁইহাট। ১৭৪০-এ মারা যান বর্ধমানের মহারাজা মহাতাব কীর্তিচাঁদ। ভাগীরথীর তীরে রাজাদের তৈরি গঙ্গাবাসের পাশেই মহাতাব কীর্তিচাঁদের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন তাঁর উত্তরসূরীরা। যা বর্তমানে সমাজবাড়ি নামে খ্যাত। কীর্তিচাঁদ দাঁইহাটে অনেকগুলি শিবমন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন। আর এক রাজা তিলোকচাঁদ দাঁইহাটে কিশোর-কিশোরী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। রাজাদের হাত ধরে কাঁসা-পিতল শিল্প, ভাগীরথীকে ঘিরে নদী-বাণিজ্যেও উন্নতি ঘটতে থাকে।
তারমধ্যেই ১৭৪২ সালের ১৫ এপ্রিল ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বাধীন বর্গি সেনারা বর্ধমানে হামলা চালায়। বর্ধমান শহর ধ্বংস করে রাজাদের গঙ্গাবাসের দখল নেওয়ার জন্য দাঁইহাটে আসে তারা। গঙ্গাবাসের দখল নেওয়ার পরেও বর্গি হামলা চলতেই থাকে। সমাজবাটি পাড়ায় ভাঙা পাঁচিল সেই স্মৃতি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে। এছাড়া নবদ্বীপ থেকে সন্ন্যাস নিতে কাটোয়া যাওয়ার পথে শ্রীচৈতন্য দাঁইহাটের পথ দিয়েই হেঁটেছিলেন বলে কথিত রয়েছে। এককথায়, কয়েকশো বছরের খণ্ডবিখণ্ড ইতিহাস নিয়ে এগিয়ে চলেছে স্থানীয় যুবক অশেষ কয়াল দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন এ শহর নিয়ে। তিনি বলেন, “বিভিন্ন পত্রপত্রিকা-পঁুথি ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, কাটোয়া শহরের চেয়ে গরিমায় এগিয়েই ছিল দাঁইহাট। এটা বললেও অতিশয়োক্তি হবে না যে জেলাতেও ‘বাণিজ্য পরগণা’ বলে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছিল এই শহর।” কাঁসা-পিতলের পাশাপাশি প্রস্তর শিল্পেও নাম ছিল দাঁইহাটের। জানা যায়, এখানকার প্রস্তর শিল্পী নবীন ভাস্কর দক্ষিণেশ্বরের কালী মূর্তি তৈরি করেছিলেন। সেই সময় কলকাতাতেও পাথরের নানা জিনিসের ব্যবসা করতেন এ তল্লাটের শিল্পীরা।
বেহাল পড়ে বাগটিকরা মন্দিরের টেরাকোটার কাজ।
শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্র হওয়াতেই ১৮৬৯ সালের ১ এপ্রিল দাঁইহাট পুরসভা গঠন হয়। ওই দিনই মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরের কাটোয়া শহরকেও পুরসভার মর্যাদা দেওয়া হয়। এই দুই শহরের জন্মও এক দিনে। অথচ বর্তমানে কাটোয়ার তুলনায় ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে দাঁইহাট। পুর পরিষেবা থেকে আধুনিক জীবনের সুযোগ সুবিধা সবেতেই দাঁইহাট যেন এক যুগ পিছিয়ে। অথচ এমনটা যে হওয়ার কথা ছিল না, তা বলছেন অনেকেই।
পুরসভা গঠনের সময় কাটোয়া ও দাঁইহাটের জনসংখ্যা প্রায় একই ছিল। দাঁইহাট পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, মাত্র ২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে এ শহর তৈরি হয়। কয়েক বছর পরে এলাকা বেড়ে হয় ৪ বর্গ কিলোমিটার। বর্তমানে দাঁইহাট পুরসভার এলাকা ১০.৩৬ বর্গ কিলোমিটার। পুরসভা সূত্রে জানা যাচ্ছে, ১৯৫১ সালে এ শহরের জনসংখ্যা ছিল ১৬,১২২ জন। তারপরে দু’দশক জনসংখ্যা বাড়লেও হঠাত্ই উল্টো গতি দেখা যায়। ২০০১ সালে পৌঁছেও এ শহরের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ২২ হাজার ৫৯৩ জনে। আরও দশ বছরে লোকসংখ্যা বাড়ে মাত্র ১৭৯৭ জন। দাঁইহাট উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বপন ঠাকুর বলেন, “কাটোয়া ও দাঁইহাট যমজ শহর। জন্মলগ্নে দুই শহরের জনসংখ্যাও পিঠোপিঠি ছিল। কিন্তু সময় যত এগিয়েছে,ততই পিছিয়ে পড়েছে দাঁইহাট। জনসংখ্যাও কমতির দিকে।”
দাঁইহাটের ১৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে চারটি ওয়ার্ডের মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। আরও দু’টি ওয়ার্ডের একাংশ বাসিন্দাও কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। পুরসভা সূত্রে খবর, দাঁইহাটের ৪০ শতাংশ এলাকায় এখনও চাষযোগ্য জমি রয়েছে। ভাগীরথী তীরের ওই জমিতে সব্জি ও পাট চাষও হয়। শহরে ৪০ শতাংশ বাড়িও মাটির কিংবা খলপার তৈরি। কয়েক বছর আগে বাম আমলের পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য দাঁইহাট পুরভবনের সামনে একটি সভায় প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, “দাঁইহাটকে শহর বলে ভাবতে অবাক লাগছে।”
এসটিকেকে রোড হওয়ায় গুরুত্ব কমেছে শহরের ভেতরের কালনা-কাটোয়া রাস্তার।
কিন্তু দাঁইহাটের এ রকম অবস্থা হল কেন?
স্থানীয় বাসিন্দাদের ব্যাখ্যা, বাম সরকার এ বঙ্গে আসার পরেই কাটোয়াকে পুর্নগঠনের কাজে হাত লাগায়। ফলে আশপাশের জেলার বহু মানুষও কাটোয়ায় এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। আর সেখানে দাঁইহাটের ভিতর থেকে পুরনো কালনা-কাটোয়া রোডের গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হয়। দাঁইহাট থেকে দু’কিলোমিটার দূর দিয়ে এসটিকেকে রোড তৈরি করা হয়। ফলে গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দাদের দাঁইহাটে ঢোকার প্রবণতা কমতে থাকে। সুদিন হারিয়ে যায় কাঁসা-পিতলের ব্যবসারও। বেশিরভাগ ব্যবসায়ীরাই দাঁইহাট ছেড়ে নদিয়ার মাটিয়ারী কিংবা কলকাতার সিমলা অঞ্চলে চলে যান। দাঁইহাটের পুরপ্রধান সন্তোষ দাসও বলেন, “মানুষের বসবাসের জন্য যে সব পরিষেবা থাকা দরকার তা কোনও আমলেই গড়ে ওঠেনি।”
বাসিন্দাদেরও অভিযোগ, গণপরিবহণ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিছুই সেভাবে গড়ে না ওঠায় এ শহরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন তাঁরা। জনসংখ্যাও বাড়েনি সে কারণেই।
তবে যে শহরে দুপুর গড়ালেই দোকানপাটের ঝাঁপ নেমে যায়, সেই দাঁইহাট জেগে ওঠে একমাত্র রাস উত্সবে।
(চলবে)