শ্রীরামপুরের গ্রামীণ ব্যাঙ্কে মহিলাদের বিক্ষোভ। নিজস্ব চিত্র।
কেউ এসেছিলেন মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা তুলতে। কারও টাকা তুলে তাঁত বোনার সুতো কিনতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পূর্বস্থলীর শ্রীরামপুরে পশ্চিমবঙ্গ গ্রামীণ ব্যাঙ্কের বাইরে সাদা কাগজে ‘টাকা নেই’ লেখা দেখেই মাথায় হাত পড়ল তাঁদের। শুক্রবার প্রথমে ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের কাছে অনুরোধ, আর্জি জানালেও পরে ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে ওই মহিলাদের। ব্যাঙ্কে তালাও ঝুলিয়ে দেন শ্রীরামপুর এলাকার বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর শ’পাঁচেক মহিলা। ভিতরে প্রায় তিন ঘণ্টা আটকে ছিলেন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার ও অন্য কর্মীরা।
স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে মহিলাদের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে অন্যতম শ্রীরামপুর। ৩০৩টি মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর প্রায় চার হাজার সদস্য রয়েছেন এখানে। পরিশ্রুত পানীয় জল, হাতে ভাজা মুড়ি, ঢেঁকি ছাঁটা চাল, তাঁতের শাড়ি, পেয়ারা বাগান-সহ নানা প্রকল্প গড়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা। গোষ্ঠীগুলির ভাল লেনদেনের জন্য পশ্চিমবঙ্গ গ্রামীণ ব্যাঙ্ক এ বছর ৪ কোটি ১১ লক্ষ টাকা ঋণ দেয়। এর আগে বিভিন্ন দফায় এই ব্যাঙ্ক গোষ্ঠীগুলিকে আরও সাড়ে ৬ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ওই স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যেরা জানান, নিয়ম করে প্রতি মাসে ব্যাঙ্কে টাকা দেন তাঁরা। তিন মাস পরে ঋণ মেলে। ঋণ দেওয়া হয় এক লক্ষ ২৫ হাজার থেকে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। গোষ্ঠীর নামে ঋণ অনুমোদন হওয়ার পরে সেখান থেকে ব্যবসা ছাড়াও অনেকে মেয়ের বিয়ে, চিকিৎসার প্রয়োজনে টাকা নেন। পরে গোষ্ঠীকে সুদ সমেত টাকা ফিরিয়ে দেন তাঁরা। পঞ্চায়েত সমিতির হিসাবে গোষ্ঠীর সদস্যরা সপ্তাহে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা লেনদেন করেন। ওই মহিলাদের দাবি, নোট বাতিলের পরে পাঁচশো-হাজারে জমানো পুঁজি সবটাই ব্যাঙ্কে দিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। এখন সাধারণ গ্রাহক কয়েক হাজার পেলেও গোষ্ঠীগুলিকে বড় অঙ্কের টাকা দিচ্ছে না ব্যাঙ্ক। তাতে মুশকিলে পড়ছেন বহু মহিলা। তাঁদের দাবি, পুঁজির অভাবে ব্যবসা সঙ্কটের মুখে। তুলে রাখতে হয়েছে তাঁত যন্ত্র। অছচ ব্যাঙ্ক ঋণের সুদ তাদের গুনতে হচ্ছে।
এ দিন সকালে প্রায় পাঁচশো মহিলা টাকা তোলার জন্য ব্যাঙ্কে আসেন। বেশির ভাগেরই হাতে ছিল চেক। চাঁদপুর গ্রামের রাজীব স্বনির্ভার গোষ্ঠীর সদস্য সাফিয়া শেখের দাবি, ‘‘১৬ দিন পর মেয়ের বিয়ে। ৫০ হাজার টাকা গোষ্ঠীর অ্যাকাউন্ট থেকে নেব ভেবেছিলাম। এক টাকাও তুলতে পারিনি।’’ তুলি স্বনির্ভার গোষ্ঠীর পায়েল রায় জানান, এক সদস্য চম্পা রায় চোখে কম দেখছেন। তাঁকে চিকিৎসার জন্য গোষ্ঠী থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু টাকা মিলছে না। বিদ্যাসাগর স্বনির্ভার গোষ্ঠীর সবিতা ধারারও দাবি, ‘‘গোষ্ঠী ১৫ হাজার টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে। এর মধ্যে আমার পেঁয়াজ চাষের জন্য ১০ হাজার এবং চৈতালি সিংহের মুরগির খাবার কেনার জন্য পাঁচ হাজার টাকা প্রয়োজন। কবে পাব কিছুই বুঝতে পারছি না।’’
এ দিন ব্যাঙ্কে এসে মহিলারা জানতে পারেন, টাকা জমা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তোলা যাচ্ছে না। এরপরেই ক্ষোভ মাত্রা ছাড়ায়। সাড়ে এগারোটার মধ্যে ব্যাঙ্ক ভবনের নীচে জড়ো হয়ে যান মহিলারা। গ্রাহকদের বাইরে আসতে বলে তালা ঝুলিয়ে দেন তাঁরা। বিক্ষোভের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দীলিপ মল্লিক এবং বিডিও পুষ্পেন চট্টোপাধ্যায়। ম্যানেজারের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিলে মহিলারা মেনে নেন। ব্যাঙ্ক ম্যানেজার অধীরকুমার সরকারের দাবি, বৃহস্পতিবার কাল টাকা না আসায় এ দিন টাকা দেওয়া যায় নি। তবে শুক্রবার বিকেলে টাকা ঢুকবে। শনিবার টাকা বিলির ক্ষেত্রে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যদের সুবিধে দেওয়ার আশ্বাসও দেন তিনি।
গলসির পুরসায় একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখায় গ্রাহক পিছু পাঁচ হাজার দেওয়ায় ক্ষোভ জানান গ্রাহকেরা। বিশেষত চাষিদের দাবি, ধান কাটার মরসুমে চাহিদা মতো টাকা পাচ্ছেন না তাঁরা। তার মধ্যে একশো টাকার নোট না থাকায় ক্ষোভ বাড়ে আরও। যদিও ব্যাঙ্ক ম্যানেজার ঋষিকান্ত বার্ণোয়ালের দাবি, পর্যাপ্ত টাকা না আসায় টাকা দেওয়া যাচ্ছে না। টাকা না এলে সপ্তাহে ২৪ হাজার টাকাও দেওয়া যাবে কি না তাতেও সন্দেহ আছে বলে জানান তিনি।
আউশগ্রাম ও মঙ্গলকোটের প্রতিটি ব্যাঙ্কে আবার এ দিন অবস্থান বিক্ষোভ কর্মসূচি করে তৃণমূল। দলের মঙ্গলকোটের ব্লক সভাপতি অপূর্ব চৌধুরী জানান, সাধারণ মানুষের যাতে অসুবিধা না হয় তার জন্যেই একশো মিটার দূরে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। আউশগ্রামের বিভিন্ন ব্যাঙ্কে বিক্ষোভে সামিল হন দুই ব্লকের সভাপতি শেখ সালেক রহমান, রামকৃষ্ণ ঘোষ প্রমুখ।