আমেনা খাতুন। ডান দিকে, শ্যামলী মণ্ডল। ছবি: নিজস্ব চিত্র উদিত সিংহ
টানাটানির সংসার। তার উপরে ‘লকডাউন’-এ কাজ হারিয়েছেন বাবা। পরিবারের চিন্তা, বাড়ির কাজের মাঝে ফাঁক পেলেই বই নিয়ে বসে পড়ত মেয়েটি। পরিশ্রম আর জেদের জোরেই ৬১১ পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে বর্ধমান শহরের কাঞ্চননগর খর্গেশ্বরপল্লির শ্যামলী মণ্ডল। লড়াই কম ছিল না গলসির পুরসার আমেনা খাতুনেরও। জন্ম থেকে দু’হাত নেই। পা দিয়ে লিখে পড়াশোনা করেছে গরিব পরিবারের মেয়েটি। ৫২১ পেয়ে জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় সফল সে।
দামোদরের বাঁধের ধারে টিন দিয়ে ঘেরা বাড়ির মাটির বারান্দায় বসে শ্যামলীর বাবা বিষ্ণুপদ মণ্ডল জানান, দিনমজুরের কাজ করতেন তিনি। ‘লকডাউন’-এ তিন মাস ঘরে বসেই কেটেছে। মেয়ের বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও তাঁর সামর্থ্য নেই। শ্যামলীও বাবার উপরে জোর না করে ভূগোল নিয়ে এগোতে চায়। কাঞ্চননগর দীননাথ দাস উচ্চ বিদ্যালয়ের এই ছাত্রী অঙ্কে ৯৮, ভূগোলে ৯৭ পেয়েছে। ইংরেজি ছাড়া, সব বিষয়েই আটের ঘরে নম্বর। স্কুল শিক্ষকেরা ছাড়া দু’জন টিউটরের কাছে পড়ত সে। মা শেফালিদেবী বলেন, ‘‘শিক্ষকেরা শুধু পড়াশোনা নয়, আর্থিক ভাবেও আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। না হলে মেয়েটাকে পড়াতে পারতাম না।’’ শ্যামলীও বলে, ‘‘প্রাণিবিদ্যা খুব ভাল লাগে। ডাক্তার হতে চাই। কিন্তু বাড়ির পরিস্থিতি যা, তাতে ভূগোল নিয়েই পড়তে হবে হয়তো।’’
স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুভাষচন্দ্র দত্ত জানান, পড়াশোনার সঙ্গে ভাল গান গায় শ্যামলী। কুইজ়েও একাধিক পুরস্কার পেয়েছে। স্কুলের কন্যাশ্রী ক্লাবের সদস্য হিসেবেও অনেক কাজ করেছে। আগামী দিনে এই কৃতী ছাত্রীর পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন স্কুল পরিচালন সমিতি সভাপতি মানিক দাসও।
বাড়ির মেজ মেয়ে আমেনাকে নিয়ে জন্ম থেকেই চিন্তা ছিল মা বিলকিস বেগম ও বাবা আল্লারাখা মল্লিকের। কিন্তু পাঁচ বছর বয়সে নিজেই পা দিয়ে লেখার চেষ্টা করে আমেনা। মেয়ের ইচ্ছে দেখে কিছু দিন পরে স্কুলে ভর্তি করেন তাঁরা। পরপর ধাপ পার করে মেয়ে মাধ্যমিক পাশ করে যাবে, এখনও ভাবতে পারেন না তাঁরা। আল্লারাখা মল্লিক জানান, অল্প কিছু জমিজমা রয়েছে। সেই আয়েই সংসার চালান তিনি। তবে অভাবে বড় হওয়া মেয়ে ছোট থেকেই স্বাবলম্বী। পা দিয়েই দৈনন্দিন কাজ করতে পারে সে। পুরসা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শুভাশিস চন্দ্র জানান, পড়াশোনায় বেশ ভাল আমেনা। লেখার সুবিধার জন্য পঞ্চম শ্রেণি থেকে ক্লাসঘরের মেঝেতে বসত ও। তবে মাধ্যমিক দিয়েছে লেখক নিয়ে। বাংলা, ইংরেজিতে ৮০ শতাংশের বেশি নম্বরও পেয়েছে।
আমেনার মা পুরসা পঞ্চায়েতের প্রধান। তাঁর কথায়, ‘‘লাজুক হলেও ছোট থেকেই ওর মনের জোর খুব বেশি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যে বাধা নয়, এই আমাদের শিখিয়েছে।’’ আর আমেনা বলে, ‘‘পড়তে খুব ভাল লাগে। স্কুলের স্যার, দিদিমণিরা ভীষণ সাহায্য করেছেন। শিক্ষিকা হওয়াই আমার স্বপ্ন।”
উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল সম্পর্কিত যাবতীয় আপডেট পেতে রেজিস্টার করুন এখানে |