প্রতীকী ছবি।
সরকারকে ধান বিক্রি করতে গেলে দেড়-দু’মাস পরে তারিখ পাওয়ার অভিযোগ থেকে শুরু করে, ধান কেনার গতি ‘কম হওয়ায়’ ক্ষোভ— অন্ত নেই চাষিদের অসন্তোষের কারণের। তাই কেন এই ‘পরিস্থিতি’ হচ্ছে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে কাটাছেঁড়া। অনেকের মুখেই ঘুরছে ‘কী হওয়া উচিত ছিল, কী হচ্ছে’— সে প্রসঙ্গ।
যা হওয়ার কথা: চাষি ধান নিয়ে কৃষক বাজার বা ‘সিপিসি’ (সেন্ট্রাল প্রোকিওরমেন্ট সেন্টার)-তে যাবেন। সেখানে ধান বিক্রি করবেন। পরিমাণমতো ‘খাদ’ বাদ দিয়ে বাকি ধানের দাম চেকে পাবেন চাষি। চালকলের দোরগোড়ায় চাষি ধান নিয়ে যাবেন না।
যা হচ্ছে: এক) কৃষক বাজার বা ‘সিপিসি’ নয়, চাষিকে ধান বিক্রি করার জন্য এত দিন দূরের চালকলে যেতে হচ্ছিল। কেন? ‘সিপিসি’ ধান কিনলেও, তা ভাঙিয়ে চাল করবে চালকল। কিন্তু রাজ্য সরকারের এক নতুন নির্দেশে তাদের একটা বড় অংশ বেঁকে বসে। এত দিন পর্যন্ত তিন হাজার টন ধান ভাঙানোর জন্য চালকলগুলিকে ‘ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি’ দিতে হত না। এ বছর সে পরিমাণটা ৫০০ টনে নামিয়ে আনা হয়। পক্ষান্তরে, ব্যাঙ্ক গ্যারান্টির অঙ্ক ২৫ লক্ষ থেকে শুরু করে ৭৫ লক্ষ টাকা করা হয়। চালকলগুলির মালিকদের একাংশের বক্তব্য, কোভিড-পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকমাস চালকল বন্ধ ছিল। তাঁদের পুঁজিতে টান পড়েছে। ‘ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি’ দেওয়ার অবস্থা তাঁদের নেই। এই পরিস্থিতিতে পূর্ব বর্ধমানে ৩৫০ চালকলের মধ্যে সরকারের সঙ্গে ধান ভাঙানোর জন্য চুক্তি করে ১০২টি। সে জন্য এক ব্লকের ধান অন্য ব্লকের চালকল কিনছিল। দূরে যেতে চাষিদের খরচও বেড়েছে।
খাদ্য দফতর সম্প্রতি নির্দেশিকা দিয়েছে, যে সব চালকল ‘ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি’ দিয়েছিল, তারা ওই অঙ্কেই দ্বিগুণ ধান ভাঙানোর জন্যে অনুমতি নিতে পারবে। তাতে ধান কেনায় গতি আসবে বলে আশা খাদ্য-কর্তাদের। তবে চাষিদের বড় অংশের দাবি, এর ফলে তাঁদের বিশেষ কোনও সুবিধে হবে না। কারণ, তাঁদের সেই দূরের চালকলেই যেতে হবে।
দুই) খাদ্য দফতরও তেড়েফুঁড়ে ধান কিনতে পারছে না। কারণ, তারা সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে ধান কিনলেও, ৪৫ দিনের মধ্যে ভাঙিয়ে চাল করা না হলে সে ধানের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকে।
তিন) কিসান মান্ডিতে কার্যত প্রশাসনিক কোনও প্রক্রিয়া হয় না বলে চালকলগুলি এক প্রকার ইচ্ছেমতো (প্রতি কুইন্টালে ১০ কেজি পর্যন্ত) ‘খাদ’ বাদ দেয় বলে অভিযোগ। এ নিয়ে প্রতিবাদ হলে, ব্লক প্রশাসন, খাদ্য দফতর ও চালকলের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত তিন সদস্যের কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়। তাতে চাষির লাভ হয় না। একে দূরে ধান দিতে যেতে হচ্ছে, তার উপরে সেখানে ‘খাদ’-এর সমস্যা থাকায় চাষিদের একাংশ সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রিতে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। ফলে, ধান সংগ্রহের কাজে প্রত্যাশিত গতি আসছে না।
চার) জেলায় উৎপাদিত ধানের সামান্য অংশ সরকার কেনায়, বাকি ধান নিয়ে কী করবেন— তা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে চাষিদের। তবে সরকারি সূত্রের দাবি, এ রাজ্যে রেশন, মিড-ডে মিল, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, ত্রাণের চাহিদা মিলিয়ে বছরে ৫২ লক্ষ টন চাল লাগে। সরকার তার বেশি চাল কিনলে, তা সদ্ব্যবহারের জায়গা নেই।
খাদ্য দফতর সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত ২১ লক্ষ টন ধান কেনা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও খোলা বাজারে ধানের দাম বাড়ছে না কেন, প্রশ্ন উঠেছে। চাষি, চালকল, ধান ব্যবসায়ীদের একাংশের দাবি, করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বা অন্য দেশে চাল রফতানি বন্ধ রয়েছে। ফলে, চালের চাহিদা কম। রেশন, মিড-ডে মিল-সহ একাধিক সরকারি প্রকল্পে বিনামূল্যে চাল মিলছে। এ সবের জেরে বাজারে চাহিদা কম থাকায় দাম বাড়ছে না বলে ধারণা তাঁদের।
‘কৃষকসভা’র বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক যদুনাথ রায়ের দাবি, এর উপরে শিবির কম হওয়ায় চাষিরা সমস্যায় পড়ছেন। যেখানে শিবির হচ্ছে, সেখানে ধান বিক্রি করতে গেলে দেড়-দু’মাস পরে তারিখ পাওয়া যাচ্ছে। অত দিন ধান ঘরে রাখতে পারছেন না অনেক চাষিই। সংগঠনের পূর্ব বর্ধমানের জেলা সম্পাদক মহম্মদ সৈয়দ হোসেনের অভিযোগ, “ধান কেনার ইচ্ছে নেই সরকারের। সে জন্য কোনও সমন্বয় দেখা যাচ্ছে না।’’
তবে খাদ্য দফতরের দাবি চালকলের সমস্যা মিটেছে। রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকেরও বক্তব্য, ‘‘সদিচ্ছা আছে বলেই এখনও পর্যন্ত ২১ লক্ষ টন ধান কিনেছে রাজ্য সরকার। বাম আমলে ধান কেনার কথা কেউ জানতেই পারতেন না।’’