বরাকর নদের পাড় থেকে কোয়ার্জ পাথর তুলে বোঝাই করা হচ্ছে ট্রাক্টরে। ছবি: পাপন চৌধুরী
নদীর পাড়ে প্রতিদিন মাটি খোঁড়ে এক দল লোক। হাত দু’-তিনেক খুঁড়লেই মেলে এক ধরনের চকমকে পাথর। ঘণ্টা চার-পাঁচেকের চেষ্টায় ঝুড়িতে করে এমন ২৫ কেজি পাথর ট্রাক্টর বা ডাম্পারে তুলে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। হাতে এসে যাবে ১০০ টাকা।
পশ্চিম বর্ধমানের সালানপুরে বরাকর নদের পাড়ের বিভিন্ন গ্রামে এটাই এখন অনেকের রুজি। এ ব্যবসা চলছে দীর্ঘদিন, তবে বাড়বাড়ন্ত হয়েছে সম্প্রতি। নদীর পাড়ে খোঁড়াখুঁড়ি করলেই ওই সাদা স্ফটিক পাথর বা ‘কোয়ার্জ’ বেরিয়ে আসে। তা এ ভাবে তুলে পাচার করা যে বেআইনি, তা জানেন ওই শ্রমিকেরা। ‘কোয়ার্জ’ পাচার হচ্ছে, সে খবর রয়েছে প্রশাসনের কাছেও। কিন্তু নিয়মের ফাঁক গলেই দীর্ঘদিন চলে আসছে এই কারবার।
সিদাবাড়ি, হদলা, সবুজদ্বীপ, কালিপাথর, বাথানবাড়ি, বাঁশকেটিয়ার মতো গ্রামগুলির বাসিন্দাদের একটা বড় অংশের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। উপার্জনের জন্য অনেকে মাইথন জলাধার বা লাগোয়া এলাকায় নৌকা চালান। কেউ-কেউ অন্যত্র দিনমজুরির কাজে যান। প্রশাসনের অভিযোগ, ওই সব গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশ এই পাথর খোঁড়েন। তাঁরা এবং কিছু বহিরাগত জড়িত পাথর পাচারে।
পাথর তোলার পরে নৌকায় করে নিয়ে গিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় জড়ো করা হয়। সময়মতো সেখান থেকে তা নিয়ে যায় ট্রাক্টর বা ডাম্পার। এই ব্যবসায় জড়িত একাধিক শ্রমিকের বক্তব্য, ‘‘এলাকায় সব সময় একশো দিনের কাজ পাওয়া যায় না। দিনমজুরিও অনিশ্চিত। তাই এই পাথর তোলাই ভরসা।’’ সালানপুর পঞ্চায়েত সমিতির বিদায়ী সভাপতি তথা এলাকার তৃণমূল নেতা শ্যামল মজুমদার অবশ্য বলেন, ‘‘কাজ না পাওয়ায় লোকে কোয়ার্জ পাচারে জড়াচ্ছে, এমনটা বলা যাবে না। যাঁদের বৈধ জব-কার্ড আছে, তাঁরা অবশ্যই কাজ পান।’’
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকাকালীনই এসে হাজির হয় একটি ট্রাক্টর। সঙ্গে মোটরবাইকে আসেন দুই যুবক। মহম্মদ শাহিদ ও মহম্মদ আলম নামে ওই দু’জন নিজেদের এই পাথরের ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিয়ে জানান, এই কোয়ার্জ প্রতি টন ৮০০ টাকা দরে ঝাড়খণ্ডের ‘ক্রাশার’ (পাথর ভাঙা কল) মালিকদের কাছে বিক্রি করেন। সাধারণত ট্রাক্টরে সাত টন ও ডাম্পারে ১৫ টন পাথর পাঠানো যায়। গড়ে প্রতিদিন তিন ডাম্পার ও দশ ট্রাক্টর পাথর সরবরাহ করেন তাঁরা। তবে বর্ষায় মাস তিনেক নদীতে জল বাড়ায় কাজ বন্ধ থাকে। প্রতি টন পাথর ৮০০ টাকায় বিক্রি করে তাঁদের লাভ কত, সে প্রশ্নের জবাব অবশ্য তাঁরা দেননি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ‘ক্রাশার’-এ এই পাথর মিহি গুঁড়ো করে বস্তায় ভরে সিরামিকের কারখানায় পাঠানো হয়। সিরামিকের জিনিস তৈরি ও মার্বেল পালিশে তা কাজে লাগে। কাচ এবং ঘড়ি নির্মাণ শিল্পেও চাহিদা রয়েছে ‘কোয়ার্জ’-এর।
এই পাথর পাচার রোখা যাচ্ছে না কেন? ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের এক আধিকারিকের দাবি, এই পাথর তুলে বিক্রির জন্য ইজারা দেওয়ার কোনও নিয়ম নেই। ফলে, এই পাথর পাচারের জন্য রাজস্ব সংগ্রহ মার খাচ্ছে, তা বলা যাবে না। কিন্তু নদীর পাড় লাগোয়া এলাকায় নিয়মিত পাথর তুলে নেওয়ার ফলে ভূমিক্ষয় হচ্ছে। তার ফল মারাত্মক হতে পারে। তা আটকাতে এই চুরি ঠেকানো দরকার। সালানপুরের বিএলএলআরও রুদ্রুরূপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আমরা অভিযান করলে কোয়ার্জ পাচার কিছু দিন বন্ধ থাকে। পরে ফের চালু হয়ে যায়।’’ ধারাবাহিক অভিযানের জন্য জেলা ভূমি সংস্কার দফতরে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, দাবি তাঁর। ওই দফতরের পশ্চিম বর্ধমান জেলা আধিকারিক তন্ময় রায়ের বক্তব্য, ‘‘প্রস্তাব এসেছে। দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি।’’