ঢেকেছে-আকাশ: কারখানা থেকে ছড়াচ্ছে দূষণ। শনিবার রাতুড়িয়া-অঙ্গদপুর শিল্পতালুকে। ছবি: বিকাশ মশান
বাতাসে এখন হালকা ঠান্ডা আমেজ। শীতএখনও জাঁকিয়ে পড়েনি। তার অনেক আগেই কুয়াশার চাদরে আচ্ছন্ন হচ্ছে দিল্লি-সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত। বায়ু দূষণের জন্য দৃশ্যমানতা কমায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনাও। চলতি সপ্তাহে নয়ডা-আগ্রা যমুনা এক্সপ্রেসওয়েতে পর পর বেশ কয়েকটি গাড়ি ধাক্কা মারে। রাজধানীর মতো অবস্থা দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলেও। বায়ু দূষণের জন্য প্রায় ২৪ ঘণ্টাই দরজা-জানলা বন্ধ রাখতে হচ্ছে দুর্গাপুরের রাতুরিয়া, অঙ্গদপুর এলাকার বাসিন্দাদের।
সব সময় দরজা-জানলা বন্ধ থাকায় দিন-রাত পাখা চালাতে হচ্ছে ছবি ভৌমিক, ফলটুসি দাস’দের। মাসে আকাশছোঁয়া বিদ্যুতের বিল আসছে। আর বাইরে বেরোলে শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত সমস্যায় ভুগতে হয়। এর একটা বিহিত চেয়ে শুক্রবার পাড়ার মহিলারা মিলে পোস্টার, ব্যানার হাতে বেরিয়েছিলেন। তবে ফল বিশেষ হয়নি।
এই অবস্থা শুধু তাঁদের নয়। দুর্গাপুরের বিভিন্ন শিল্পতালুক সংলগ্ন সব বাসিন্দাদেরই। মিশ্র ইস্পাত, স্পঞ্জ আয়রন, পিগ আয়রন, ফেরো ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতি কারখানার চিমনি দিয়ে দিন-রাত গল গল করে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বেরোচ্ছে সুক্ষ্ম ছাই। বাতাসে ভেসে গিয়ে তা ঢুকে পড়ছে আশপাশের বাড়িতে। গাছের পাতা ছাইয়ে ঢাকা। পুকুরের জলে দূষণের মোটা আস্তরণ। বাড়ির বারান্দা বা উঠোন একদিন ঝাঁট না দিলে ছাইয়ে ঢাকা পড়ে যায়। শিল্পতালুক সংলগ্ন বাসিন্দাদের সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে তাই প্রথম কাজ, ঝাঁট দিয়ে বারান্দা ও উঠোন কালিমামুক্ত করা। এরপর বন্ধ দরজা, জানলা মুছে পরিষ্কার করা।
রাতুরিয়া-অঙ্গদুপর শিল্পতালুক সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা ছবি, ফুলটুসি’রা জানালেন, দিল্লি, কলকাতার মতো দূষণে জেরবার তাঁরা। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের জন্য ঘন কুয়াশায় ঢেকে রয়েছে দিল্লির রাস্তাঘাট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বায়ু দূষণের যে মাত্রাকে গ্রহণযোগ্য নিরাপদ সীমা বলে মনে করে, দিল্লির অনেক এলাকায় বায়ু দূষণ এখন তার তিরিশ গুণ বেশি। তাঁদের কথায়, ‘‘দূষণের ভয়ে বাড়ির দরজা-জানলা সারাদিন বন্ধ রাখতে হয়। ঘরে আলো-পাখা চলছে দিন-রাত। বিদ্যুতের বিল আসছে দ্বিগুণেরও বেশি। ঘরের বাইরে বেরোলে দূষণের জেরে বিপাকে পড়ছেন বিশেষ করে বয়স্ক ও শিশুরা। শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যায় ভুগছেন কেউ কেউ। বাড়ছে চর্মরোগ ও চোখের সমস্যা। রোদে কাচা শাড়ি, জামা-কাপড় মেললে তা উল্টে বাতাসে উড়ে আসা কালো ছাই লেগে ময়লা হয়ে যায়।’’ শুক্রবার শিল্পতালুকের বিভিন্ন কারখানায় বিক্ষোভ দেখানোর পরেও শনিবার পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি বলে জানিয়েছেন তাঁরা। ভবিষ্যতে কী করা যেতে পারে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে।
সগরভাঙা, অঙ্গদপুর, রাতুরিয়া, বাঁশকোপা প্রভৃতি এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, দিনে দূষণের মাত্রা তাও সামান্য কম থাকে। তবে বিকেলের পর থেকে রাস্তা দিয়ে খালি চোখে হাঁটা বা মোটরবাইক চালিয়ে যাওয়া যায় না। চোখ জ্বালা করে। শিল্পাঞ্চলে দূষণ অবধারিত হলেও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু তা সঠিকভাবে না হওয়ায় বাতাসে বিপজ্জনক ভাসমান কণার উপস্থিতি বাড়ে। বাসিন্দাদের দাবি, কারখানাগুলি দূষণ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র ব্যবহার না করে বিদ্যুৎ খরচ বাঁচায়। তার ফল ভুগতে হয় আশপাশের বাসিন্দাদের। বেসরকারি কারখানা মালিকদের সংগঠন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল আয়রন অ্যান্ড স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন’ তথা ‘বামুনাড়া ইন্ডাস্ট্রিজ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের’ সভাপতি শঙ্করলাল অগ্রবাল অবশ্য বলেন, ‘‘সব কারখানা নিয়ম মানে না এটা ঠিক নয়। অধিকাংশ কারখানাতে নিয়ম মেনেই উৎপাদন হয়। দু’একটি কারখানা হয়তো এমন করে থাকতে পারে। আমরা খোঁজ নেব।’’
দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তরফে দূষণ রোধে তেমন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে অভিযোগ করেছেন বাসিন্দারা। পর্ষদ অবশ্য অভিযোগ মানতে চায়নি। পর্ষদের এক কর্তা জানান, দুর্গাপুরের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে ৪টি জেলার কাজকর্ম পরিচালিত হয়। কর্মী সঙ্কটে ভুগছে কার্যালয়টি। উপযুক্ত পরিকাঠামো না থাকায় নিয়মিত অভিযান চালানো সম্ভব নয়। তবে মাঝে মাঝে হানা দিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষকে জরিমানা করা করা হয় বলে দাবি করেছেন তিনি।