ময়রা শ্মশান লাগোয়া কল থেকে নিতে হচ্ছে জল। নিজস্ব চিত্র
এক টিন জল ৩ টাকা। এক ট্যাঙ্কার জলের দর সাড়ে তিনশো টাকা। এ ছাড়া দু’ থেকে চার কিলোমিটার দূরেও ছুটতে হয় জল আনতে। — দীর্ঘ দিন ধরে এলাকার জল-ছবিটা এমনই বলে অভিযোগ অন্ডালের উখড়ার বাসিন্দাদের। বাসিন্দাদের ক্ষোভ, প্রতি বারের মতো এ বারেও পঞ্চায়েত ভোটের আগে ‘জল-সমস্যা সমাধান হবে’ বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে নানা রাজনৈতিক দল। কিন্তু এলাকাবাসীর অভিজ্ঞতা, ভোট মিটলেই অবস্থা যে কে সেই। তবে অভিজ্ঞতা যাইই হোক না কেন, এ বারেও ভোটের আগে উখড়া সরগরম ‘জল’ ইস্যুটি নিয়েই।
কী রকম? উখড়া গ্রামের বাসিন্দা তথা বিজেপি-র আসানসোল জেলা সম্পাদক জিতেন চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ২০১৫-য় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অটল মিশন ফর রেজুভেনেশন অ্যান্ড আরবান ট্রান্সফর্মেশন’ (অম্রুত) প্রকল্পে ন’শো কোটি টাকা অনুমোদন করিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু রাজ্য সরকার এই সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ২০১৭-র অক্টোবরে। ওই বিজেপি নেতার দাবি, এ ভাবে কাজ চললে ২০১৯ সালেও তা শেষ হবে না।
কংগ্রেস নেতা শোভনলাল সিংহহণ্ডার আবার দাবি, “আমাদের দাবি মেনে উখড়া থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরের আসানসোলের কালাঝরিয়া প্রকল্প থেকে ১৯৯৮ সালে রাজ্য সরকার জল সরবরাহের ব্যবস্থা করে। কিন্তু এত দূর থেকে পর্যাপ্ত জল পাওয়া সম্ভব নয় বুঝে তৃণমূল সরকার পাণ্ডবেশ্বরে অজয় থেকে বোরহোলের মাধ্যমে জল তুলে উখড়ার জল সমস্যা মেটানোর পরিকল্পনা নিয়েছে।’’ কংগ্রেসের দাবি, এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হবে। কারণ, প্রায় বছরভরই অজয়ে জল থাকে না। কংগ্রেসের প্রস্তাব, অন্ডালের কাছে দামোদরের জল নিয়ে জলপ্রকল্প করা যেত। অদূরে দুর্গাপুর ব্যারাজ হওয়ায় সেখানে গ্রীষ্মেও পর্যাপ্ত জল মেলে। স্থানীয় নকশাল নেতা কালিয়া বাউরির দাবি, ‘‘১৯৯৮ সালে পরিস্রুত জলের দাবিতে আন্দোলন করেছিলাম। তার পরে জল এলেও সঙ্কট তো কাটেইনি, উল্টে বেড়েছে।’’
যদিও স্থানীয় প্রশাসন তথা তৃণমূলের একাংশ আবার দোষ চাপিয়েছে রেলের উপরে। উখড়া পঞ্চায়েতের প্রধান দয়াময় সিংহের দাবি, নতুন প্রকল্পের পাইপলাইন ও কলের খুঁটি পোঁতার কাজ সর্বত্র শেষ। নদ থেকে উখড়া পাইপ লাইনের প্রায় ৯০ শতাংশই পাতা হয়ে গিয়েছে। দয়াময়বাবুর অভিযোগ, ‘‘তিনটি জায়গায় রেল লাইনের তলা দিয়ে পাইপলাইন আনতে হবে। দু’জায়গায় অনুমতি দিলেও এক জায়গায় এখনও অনুমতি দেয়নি রেল। আলোচনা চলেছে। ঠিক সময়ে রেল অনুমতি দিলে এক বছর আগেই জল-সমস্যা মিটে যেত।’’
রাজনৈতিক চাপানউতোরের মধ্যে উখড়ার জল-ছবিটা ঠিক কেমন?
এলাকায় গিয়ে জানা গেল, ১৯৯৮ সালে পাইপলাইন পাতে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। কিন্তু অভিযোগ, প্রথম থেকেই ওই দফতরের বসানো কলে জল পড়েনি শুকো ও বাউরিপাড়ায়। মাত্র দু’বছর জল এসেছিল ধীবর, ময়রা, মুসলিম ও চুনারিপাড়ায়। অভিযোগ, পাইপলাইনই পৌঁছায়নি মাঝপাড়া, শেরগোড়েপাড়া ও ডাঙালপাড়ায়। এ ছাড়া অন্য সব এলাকায় এই মুহূর্তে জল পড়ে কখনও সপ্তাহে তিন দিন, কখনও বা মাসে তিন দিন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জলের জন্য ভরসা স্থানীয় কুয়ো, পুকুর। না হলে দূরে গিয়ে অথবা জল কিনতে হয়। গরম পড়লে এই অবস্থা আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। উখড়া বণিক সংগঠনের তরফে তারিক সোহেল সিদ্দিকি জানান, বছরের অনেক সময়েই বাধ্য হয়ে দোকানদারদের জল কিনতে হয়। ঠেলা, রিকশায় করে জল পৌঁছে দেওয়া হয়। প্রতি টিনের দাম পড়ে তিন থেকে পাঁচ টাকা। বাসিন্দারা জানান, জলাশয় কত দূরে, সেই দূরত্ব অনুসারে এই দাম বাড়ে-কমে। গ্রীষ্মে অনেক এলাকাতেই জলের ট্যাঙ্কার কেনা হয়। সাধারণ ভাবে, এক ট্যাঙ্কারে তিন হাজার লিটার জল থাকে। ট্যাঙ্কারে জল নিয়ে এসে জল সরবরাহকারীরা বাড়ির কুয়োয় ফেলে দেন। সুভাষপাড়ার বাসিন্দা সৌভিক বন্দ্যোপধ্যায়, সোমণ্ডলপাড়ার নির্মল নন্দী, চুনারিপাড়ার পম্পা দাস জানান, গ্রীষ্মে বাড়ি ও পাড়ার কুয়োয় জল শুকিয়ে যায়। এক কিলোমিটার দূরে শঙ্করপুর মোড় ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, তিন কিলোমিটার দূরের নবঘনপুর বা চার কিলোমিটার দূরের ময়রা শ্মশান লাগোয়া কল থেকে জল ভরে নিয়ে আসেন অনেক।
বাসিন্দাদের ক্ষোভ, প্রতি বার ভোট এলেই রাজনৈতিক দলগুলি জল সমস্যা মিটবে বলে গালভরা প্রতিশ্রুতি দেয়। এ বারেও তার অন্যথা হচ্ছে না বলে দাবি।