মাটি ফুঁড়ে আগুন ও ঝাঁঝালো গন্ধ মিশ্রিত ধোঁয়া বেরোয়

ধস-আতঙ্কে ঘুম আসে না রাতে

অবৈধ কয়লা খাদানের কারবারে প্রতিদিন লুঠ হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার দেশের সম্পদ। ফলে, অসাধুরা ফুলে-ফেঁপে উঠছে। সরকারের ঘরে ঢুকছে না রাজস্ব। এই সমস্যার পাশাপাশি বিস্তীর্ণ এলাকার জনপদ ও বসতি ধসের কবলে পড়ছে। পাতালে তলিয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, মানুষও।

Advertisement

সুশান্ত বণিক

আসানসোল শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৮ ০১:৪৭
Share:

ব্যস্ত এলাকায় ধসে গিয়েছে রাস্তা। ছবি: পাপন চৌধুরী

অবৈধ কয়লা খাদানের কারবারে প্রতিদিন লুঠ হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার দেশের সম্পদ। ফলে, অসাধুরা ফুলে-ফেঁপে উঠছে। সরকারের ঘরে ঢুকছে না রাজস্ব। এই সমস্যার পাশাপাশি বিস্তীর্ণ এলাকার জনপদ ও বসতি ধসের কবলে পড়ছে। পাতালে তলিয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, মানুষও।

Advertisement

তবে মুখ্যমন্ত্রীর কড়া নির্দেশের পরেই নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ। অবৈধ খাদান বন্ধে আরও বেশি তৎপরতা শুরু হয়েছে। আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের কমিশনারের দাবি, ইসিএলের সঙ্গে যৌথ সমন্বয় গড়ে বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

অবৈধ কয়লা খাদানের জন্যই এই বিস্তীর্ণ খনি এলাকা জুড়ে ঘনঘন ধস নামছে, তার স্বপক্ষে জোরালো যুক্তি দিয়েছেন ইসিএলের কর্তারা। সংস্থার খনি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভূগর্ভস্থ কয়লার স্তর কেটে তোলার পরে মাটির তলার ফাঁপা অংশে বালি দিয়ে ভরাট করতে হয় বা শাল কাঠের খুঁটি দিয়ে মাটির উপরের অংশ ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। তবে আধুনিক প্রযুক্তিতে হাইড্রোলিক লংওয়াল পদ্ধতি ব্যবহার করেও মাটির উপরের অংশ ধরে রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে। এটাই হল ধস প্রতিরোধের সর্বোত্তম ব্যবস্থা। কিন্তু অবৈধ খাদানে মাটির গভীরে সুড়ঙ্গ বানিয়ে কয়লা তোলার পরে ফাঁপা অংশ ভরাট করা হয় না। ফলে লাগামছাড়া ধসও নামে। খনি বিশেষজ্ঞরা আরও জানিয়েছেন, কয়লা মাফিয়ারা মাটির যেখানে সেখানে গত খুঁড়ে সুড়ঙ্গ বানিয়ে কয়লা তুলছে। কিন্তু গর্তের মুখগুলি সুরক্ষিত নয়। বাইরের বাতাস ওই গর্তের মুখ দিয়ে মাটির গভীরে চলে যায়। সেখানে কয়লার স্তরে সঞ্চিত মিথেন গ্যাসের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় আগুন ধরে যায়। সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় মাটির গভীরে থাকা মজুত কয়লার স্তর। ফলে, মাটির উপরের অংশ আলগা হয়ে ধস নামে। আবার লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার দেশের সম্পদও পুড়ে ছাই যাচ্ছে।

Advertisement

ইসিএল সূত্রে জানা গিয়েছে, কুলটির ডিসেরগড়, আলডিহি, সালানপুরের সামডি, জামুড়িয়ার শ্রীপুর, জেকেনগর, বারাবনির মোহনপুর, মনোহরবহাল-সহ এই খনি শিল্পাঞ্চলের প্রায় ১৩৯টি এলাকায় ভয়াবহ ধসের আকার নিয়েছে। এই সব এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, মাঝে মাঝেই মাটি ফুঁড়ে আগুন ও ঝাঁঝালো গন্ধের ধোঁয়া বেরোতে থাকে। চড়চড় করে মাটি ফেটে যায়। দুলতে থাকে ঘরবাড়ি। ডিসেরগড়ের বাসিন্দা বিমান মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘প্রতি রাতে ‘পাতাল প্রবেশের’ আতঙ্ক নিয়ে ঘুমোতে যাই।’’

এই ডিসেরগড়েই ২০১৩ সালে আচমকা বাড়ির উঠোনে মাটি ফেটে গভীরে তলিয়ে গিয়েছিলেন ১৫ বছরের হীনা পারভিন। ভূগর্ভের আগুনে নিমেশেই দগ্ধ হয়ে মারা যায় সে। ইসিএল ও রাজ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে ধস কবলিত অঞ্চলের বাসিন্দাদের উঠে যাওয়ার আবেদনও করা হয়েছে। এলাকার বাসিন্দাদের পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা করছে কেন্দ্রীয় কয়লামন্ত্রক। কেন্দ্রের দেওয়া ২৬২৯ কোটি টাকার এই পুনর্বাসন প্রকল্পটি রূপায়ণের দায়িত্ব নিয়েছে রাজ্য সরকার।

ইসিএলের আধিকারিকদের দাবি, অবৈধ খাদানের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই ইসিএলের বৈধ খনিগুলির নিরাপত্তা বিপন্ন হচ্ছে। কেমন? উত্তরে সংস্থার কারিগরি দফতরের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, চোরেরা ভূগর্ভে অবৈধ খাদানের সুড়ঙ্গের মুখ বৈধ খনির মুখের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। ফলে, বর্ষায় অবৈধ খাদানের মুখ দিয়ে বৃষ্টির জল বৈধ খনিতে ঢুকে যায়। ফলে খনিগর্ভে কর্মরত শ্রমিকেরা বিপদের মুখে পড়েন। একই ভাবে মিথেন গ্যাসের সঙ্গে বাতাসের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অবৈধ খাদানের আগুনও বৈধ খনিতে ছড়িয়ে বিপদ ঘটায়। এই অবস্থায় নিরাপত্তার জন্য খনির কাজ বন্ধ করতে হয়।

অবৈধ কয়লা খাদানের কারবারে শুধুমাত্র ইসিএল বা সাধারণ জনপদেরই ক্ষতি হয় না। রাজ্য সরকারের রাজস্বও মার খাচ্ছে। ইসিএল সূত্রে জানা গিয়েছে, সংস্থার ৯৪টি কয়লাখনি থেকে গোটা বছরে যে পরিমাণ কয়লা তোলা হয়, তা থেকে ইসিএলের যা আয় হয়, তার ২৫ শতাংশ টাকা রাজ্য সরকারেক রাজস্ব হিসেবে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২০ শতাংশ টাকা গ্রামীণ এলাকার উন্নয়নে ও ৫ শতাংশ টাকা প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় হয়। ইসিএলর আধিকারিকেরা জানিয়েছেন, অবৈধ খাদানের জেরে ইসিএলেরই কয়লা লুঠ হচ্ছে। অর্থাৎ, ওই কয়লা ইসিএল তুলতে পারছে না বলে রাজ্য সরকারও রাজস্ব পাচ্ছে না। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, সরকারের এই রাজস্ব ক্ষতির বিষয়টি ভাল ভাবে নেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি পুলিশকে তাই অবৈধ খাদান বন্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

যদিও ধস ও এলাকার উন্নয়ন, নিরাপত্তা প্রসঙ্গে ইসিএলের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন বিভিন্ন সময়ে ইসিএলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। এখনও করছে। ধস প্রসঙ্গে এলাকাবাসীর অভিযোগ, শুধু অবৈধ খনির জন্য নয়, বৈধ খনির জন্যও অনেক সময় এলাকায় ধস নামে। কারণ, ইসিএল কয়লা তোলার পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় না। যদিও এই সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ইসিএলের কর্তারা।

পুলিশ কমিশনার লক্ষ্মী রনারায়ণ মিনা বলেন, ‘‘আমরা অবৈধ খাদান ড্রেজিং করে ভরাটের কাজ শুরু করেছি। আরও কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য ইসিএলের সঙ্গে সমন্বয় বৈঠকও করা হবে।’’ ইসিএলের সিএমডির কারিগরি সচিব নীলাদ্রি রায় বলেন, ‘‘অবৈধ খাদান বন্ধে পুলিশকে সব রকম ভাবে সাহায্য করা হবে।’’ তিনি জানিয়েছেন, ইসিএলের বিভিন্ন এরিয়ার পক্ষ থেকেও এর আগে অনেক জায়গায় ড্রেজিং করে খাদান ভরাট করা হয়েছে।

(শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement