সরকারি ওযুধ পাচারের নাল্শ নার্সিং হোমের বিরুদ্ধে। প্রতীকী চিত্র।
বহুতলের একটি আবাসনের ঘরে ঢুকে খাটের পাশে আলমারি খুলতেই দেখা গিয়েছে, জামা-কাপড় রাখার জায়গায় থাকে-থাকে সাজানো ওষুধের প্যাকেট। সেগুলিতে লেখা ‘নট ফর সেল’ বা ‘গভর্নমেন্ট সাপ্লাই’। খাটের নীচেও রাখা ছিল ওষুধের প্যাকেট। এ সবের সঙ্গে একটি ছোট ডায়েরি উদ্ধার হয়েছে। তা থেকে বর্ধমান শহর ও বীরভূমের কয়েকটি নার্সিংহোমে সরকারি ওষুধ পাচার হয়েছে বলে তথ্য মিলেছে, দাবি পুলিশের। তদন্তকারীদের আরও দাবি, প্রতি মাসে পাঁচ-সাত লক্ষ টাকার ওষুধ পাচার করা হত। লক্ষাধিক টাকা বকেয়া রয়েছে বলেও জানা গিয়েছে।
মঙ্গলবার রাতে বর্ধমানের বাহির সর্বমঙ্গলা পাড়ার দুর্গামন্দিরের কাছে ওই আবাসন থেকে সৌরেন্দ্রনারায়ণ রায় নামে এক ব্যক্তিকে সরকারি ওষুধ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করে জেলা এনফোর্সমেন্ট বিভাগ। পুলিশ সূত্রের দাবি, জেরায় ওই ব্যক্তি কোথায় কোথায় সরকারি ওষুধ সরবরাহ করতেন, তা জানিয়েছেন। ওষুধ কার মাধ্যমে তাঁর কাছে আসত, তা-ও জানিয়েছেন। সেই সূত্র ধরে সরকারি ওষুধ পাচার চক্রে জেলা এনফোর্সমেন্ট বিভাগ আরও এক জনকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশ জানায়, বুধবার রাতে বর্ধমানের ভাতছালা থেকে দেবদাস দত্ত নামে এই দ্বিতীয় জনকে ধরা হয়েছে। বৃহস্পতিবার পুলিশ আদালতে দাবি করেছে, দেবদাসই সরকারি ওষুধ সরবরাহ করত সৌরেন্দ্রনারায়ণকে। সৌরেন্দ্রনারায়ণ সে ওষুধ পৌঁছে দিত নার্সিংহোমগুলিতে।
কী ভাবে ওষুধ পৌঁছত নার্সিংহোমে? তদন্তকারীদের দাবি, বীরভূমের নার্সিংহোমগুলিতে মূলত বাছাই করা অ্যাম্বুল্যান্সের চালকেরা ওষুধ নিয়ে যেতেন। বীরভূম থেকে রোগী বর্ধমানে আনার পরে ফেরার পথে ওষুধ নিয়ে যাওয়াই দস্তুর ছিল। আর বর্ধমানের নার্সিংহোমগুলিতে মূলত সৌরেন্দ্রনারায়ণই ওষুধ পৌঁছতেন। পুলিশের দাবি, সৌরেন্দ্রনারায়ণের বাড়ি থেকে মেলা ডায়েরি থেকে পুলিশ জেনেছে, সরকারি ওষুধগুলি কম দামে কিনতেন তিনি। তার পরে নার্সিংহোমে বিক্রি করতেন। ওই সব ওষুধ খোলাবাজারে কিনতে গেলে নার্সিংহোমকে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। কম দামে পাওয়ার জন্য বেআইনি জেনেও নার্সিংহোমগুলি সে দিকে ঝুঁকত।
পুলিশের দাবি, সৌরেন্দ্রনারায়ণ জেরায় তাদের জানিয়েছেন, ভাতছালার দেবদাসের মতো বর্ধমানে অন্তত ৫০ জন রয়েছেন, যাঁরা সরকারি ওষুধ বর্ধমান শহর ছাড়াও গ্রামের হাতুড়েদের সরবরাহ করে থাকে। পুলিশ সূত্রের আরও দাবি, দেবদাসও তাদের জানিয়েছেন, তিনি কলকাতার একটি বাজার থেকে ওষুধ কিনে সরবরাহ করতেন। দেবদাসের সঙ্গে সৌরেন্দ্রনারায়ণের ব্যবসায়িক চুক্তিপত্রও তাঁদের হাতে এসেছে বলে তদন্তকারীদের দাবি।
জেলা পুলিশের এক আধিকারিকের দাবি, “দেবদাসকে কলকাতা নিয়ে গিয়ে পুনর্গঠন করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। তাঁকে জেরা করলে আরও কিছু তথ্য উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। জেলার হাসপাতালগুলির উপরেও তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়েছে।’’ জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক (সিএমওএইচ) প্রণব রায়ের দাবি, ‘‘যে পদ্ধতিতে ওষুধ জেলার গুদাম থেকে একেবারে শেষ প্রান্তে থাকা রোগীর কাছে পৌঁছয়, তাতে পাচার হওয়া কার্যত অসম্ভব। মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধও নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে নষ্ট করতে হয়। এর পরেও কেউ জড়িত আছে কি না, তা পুলিশের তদন্তে বোঝা যাবে।’’ দেবদাস ও পুলিশ হেফাজতে থাকা সৌরেন্দ্রনারায়ণকে বর্ধমান আদালতে তোলা হয়। দেবদাসকে দু’দিন পুলিশ হেফাজত ও সৌরেন্দ্রনারায়ণকে ছ’দিন জেল হেফাজতে পাঠানো হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বুধবার রাতে বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলির সংগঠন ‘প্রোগ্রেসিভ নার্সিংহোম ও হাসপাতাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর বর্ধমান শাখা একটি বৈঠক করেছে। সেখানে সরকারি ওষুধ পাচারের দায় নার্সিংহোমের ঘাড়ে চাপছে বলে আলোচনা হয়। ওই সংগঠনের রাজ্য চেয়ারম্যান শেখ আলহাজউদ্দিন বলেন, “এ ধরনের বিষয়ের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। তবু বৈঠক ডেকে প্রত্যেককে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।’’