একলাখি এলাকায় অবাধে নদী থেকে বালি তুলে গরুর গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
একটা খুনই ফের সামনে এনে দিল বর্ধমানের দক্ষিণ দামোদর এলাকার বালি মাফিয়াদের দাপট, অবৈধ বালি খাদানের রমরমা।
রবিবার রাতে মাধবডিহির আলমপুরে খুন হওয়া রায়না ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শেখ আব্দুল আলিম ওরফে বাবলুর পরিজনদেরও অভিযোগ, বালি মাফিয়াদের কাছ থেকে দলের অন্য লোকেরা তোলা আদায় করত। তা বন্ধ করার চেষ্টাতেই প্রাণ গেল বাবলুর। এলাকার বাসিন্দা থেকে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর, সেচ দফতর থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও বালি মাফিয়াদের এই রমরমার পিছনে পুলিশের বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করেন।
পুলিশ সূত্রের দাবি, দক্ষিণ দামোদর এলাকায় ২০০৯ সালের পর থেকে যে যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ হয়েছে, তা মূলত বেআইনি বালি খাদানকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের নেপথ্যেও সেই বালি খাদানের দখলই রয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের। পুলিশের হিসাবে, গত কয়েক বছরে বালি খাদানকে কেন্দ্র করে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। গুলিতে জখম হয়ে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও অন্তত ২২ জন। গত বছরের এই সময়েই ইদিলপুরে দু’দল বালি মাফিয়ার সংঘর্ষে পাঁচ জন জখম হয়েছিলেন।
রবিবার রাতের ঘটনাতেও সেই ছায়া দেখছেন বিরোধী থেকে পরিবারের লোকজন সকলেই। সিপিএমের দক্ষিণ দামোদর জোনাল কমিটির দফতরে বসে দলের এক প্রবীণ কর্মী বলেন, “বলতে গেলে মাধবডিহি থানা ভবনের কাছেই খুন হয়েছেন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। তিনি যে দলেরই হোক না কেন, পুলিশের ভূমিকায় অবাক হচ্ছি। মাধবডিহি থানা তো নিশ্চিত ভাবে জানত, বালি খাদান নিয়ে গোলমাল চলছে।” সোমবার নিহতের স্ত্রী রুনা লায়লাও বলেছিলেন, “গত মার্চ মাসে ওদের দ্বন্দ্ব বন্ধ করার জন্য মাধবডিহি থানার ওসি মীমাংসা করে দিয়েছিলেন।” জেলা পুলিশের কর্তারা জানতে পেরেছেন, স্থানীয় উচালন গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার দ্বারকেশ্বর নদী থেকে বেআইনি ভাবে বালি তুলতেন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি খুনে অভিযুক্ত দেবাশিস সামন্ত, আনিসুর রহমানেরা। তাঁদের সাহায্য করতেন আর এক অভিযুক্ত, নিহতের ‘বন্ধু’ শেখ কলিমুদ্দিন ওরফে বাপ্পা। এই খুনের ঘটনায় পুলিশ এখনও পর্যন্ত ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে। ধৃতদের এ দিন বর্ধমান জেলা আদালতে তোলা হলে তিন জনকে সাত দিনের পুলিশ হেফাজত ও বাকিদের ১৪ দিন জেল হেফাজতের নির্দেশ দেন বিচারক।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, দামোদর ও দ্বারকেশ্বর নদীর উপর খণ্ডঘোষ, রায়না ১ ও ২ ও জামালপুর ব্লক মিলিয়ে মোট ৯৭টি বৈধ খাদান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর অন্তত দশ গুণ বেআইনি বালি খাদান রয়েছে। জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের দাবি, রায়না ২ ব্লকের উচালন পঞ্চায়েতের একলাখিতে ৩টে ও মনিয়ারিতে ১টি বৈধ খাদান রয়েছে। যদিও একলাখিতে নির্দিষ্ট এলাকার বাইরেও দেদার বালি চুরির অভিযোগ হামেশাই উঠছে। এ ছাড়া নরোত্তমবাটি, বাবলাতেও প্রচুর অবৈধ খাদান রয়েছে। খণ্ডঘোষের কামালপুর, শশঙ্গা, সুন্দরপুর, কেশবপুর, রায়নার জ্যোৎসাদি, বামুনিয়া-সহ একাধিক জায়গা থেকেও বেআইনি বালি তোলা হয় বলে ওই দফতরের এক সূত্রের দাবি। স্থানীয়রা জানান, দিনের বেলা নৌকা করে বালি তুলে নদীর পাড়ে জড়ো করা হয়। আবার গরু বা মোষের গাড়ি করেও বালি তুলে এনে অন্যত্র জড়ো করে রাখে মাফিয়ার দল। তারপর রাতে লরির পর লরি এসে ওই বালি নিয়ে যায়।
বেআইনি বালি কারবারের রমরমা বোঝা যায় বর্ধমান (দক্ষিণ) মহকুমাশাসক নীতিন সিংহানিয়ার কথাতেও। তিনি বলেন, “আমরা এখন রাস্তার বিভিন্ন মোড়ে শিবির করে বেআইনি বালির গাড়িগুলিকে আটক ও জরিমানা করছি। এখনও কতগুলি বেআইনি বালি খাদান রয়েছে হিসেব নেই। তবে শীঘ্রই ওই বালিখাদান বন্ধ করার জন্য অভিযান চালাব।” তাঁর দাবি, গত মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে মাত্র দু’দিন অভিযান চালিয়ে ১৩৮টি বালির গাড়ি আটক করা হয়েছিল। সেখান থেকে সাড়ে ৩৩ লক্ষ টাকা জরিমানাও আদায় হয়েছিল। তবে এই পরিসংখ্যান তো হিমশৈলের চূড়া— বলছেন ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের এক কর্তাই। তাঁর দাবি, ‘‘কয়েক বছর আগে পালশিটের কাছে আমরা বালির গাড়ি আটক করছিলাম। সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত জেলাশাসক। কিন্তু মাফিয়াদের দাপট এতটাই যে তারা পিস্তল বের করে আমাদের তাড়া করে। আমরা সেখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হই।’’
রায়নার হিজলনা এলাকায় চলছে নৌকায় বালি তোলা।
প্রশাসনের কর্তাদের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সাধারণ মানুষের কি অবস্থা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশের সঙ্গে বালি মাফিয়াদের যোগাযোগ থাকায় পুলিশকে বারবার বলেও কিছু হয় না। তার উপর এই খাদানগুলোর পিছনে রয়েছে তৃণমূলের ছোট-বড় নেতাও। ফলে মুখে কুলুপ এঁটে থাকা ছাড়া রাস্তা নেই বলেই দাবি সাধারণ মানুষের। সিপিএমের প্রাক্তন জেলা সম্পাদক অমল হালদারেরও অভিযোগ, “পুলিশ ও তৃণমূলের মদতে বেআইনি বালি খাদানগুলি চলছে। বালি মাফিয়াদের দাপটও দিনদিন বাড়ছে।” তবে তৃণমূলের জেলা সভাপতি স্বপন দেবনাথের পাল্টা দাবি, “সিপিএমের মদতেই বেআইনি বালিখাদানগুলি চলত। এখন কোথাও বেআইনি বালিখাদান নেই।”
আর বর্ধমান জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, “মাফিয়াদের সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগ ঠিক নয়। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর ও সেচ দফতরকে বেআইনি বালি খাদান বন্ধ করার জন্য সব সময় সাহায্য করা হয়।”
ছবি: উদিত সিংহ।