বুথের আশপাশে জড়ো হওয়া যুবকদের তাড়া কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানের। সোমবার ভাতারে। ছবি: সুপ্রকাশ চৌধুরী।
বর্ধমান পূর্ব কেন্দ্রে বুথের সংখ্যা ১৯১৯টি। এর মধ্যে ১৪৬টিতে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে ফের নির্বাচন চেয়ে বিজেপি চিঠি দিল নির্বাচন কমিশনকে। সিপিএমের তরফে অভিযোগ জমা পড়েছে ভুরি ভুরি। জেলাশাসক অনুরাগ শ্রীবাস্তব বলেন, ‘‘শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে। খুব একটা বড় গোলমাল নজরে আসেনি।’’
বিজেপির দাবি, যেখানেই সংগঠন দুর্বল সেখানে ভোটারদের বুথে যেতে দেওয়া হয়নি। তার আগেই রাস্তায় ব্যারিকেড করে আটকে দেওয়া হয়েছে। বেগপুর, সুলতানপুর, কাঁকুরিয়া, মন্তেশ্বরে শাসকদল সন্ত্রাস করেছে বলে তাদের দাবি। বহু জায়গায় ‘কুইক রেসপন্স টিম’ দেরিতে এসেছে বলেও বিজেপির দাবি। বর্ধমান পূর্ব কেন্দ্রের দলের কনভেনার ধনঞ্জয় হালদার বলেন, ‘‘পুর্ননির্বাচন যেখানে চাওয়া হয়েছে সেখানে অবাধে ভোট লুট করেছে তৃণমূল। তবে বাকি জায়গায় নির্বিঘ্নে ভোট হয়েছে।’’ পূর্বস্থলী উত্তর কেন্দ্রের সিপিএম বিধায়ক প্রদীপ সাহারও দাবি, কয়েকটি আসনে ভোট লুঠ করেছে তৃণমূল। তৃণমূলের জেলা সভাপতি স্বপন দেবনাথের দাবি, ‘‘কোথাও বিরোধীদের ভোট দানে বাধা দেওয়া হয়নি। এ বারের ভোটে আমরা ৫২টি অভিযোগ করেছি। কোথাও আমাদের কর্মীদের দূর থেকে ইট ছুড়ে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোথাও কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ম ভেঙে বুথে ভিতরে ঢুকেছে।’’
ভাতার এরুয়ার বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া একটি গাছতলায় ক্যাম্প অফিস থেকে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ উঠেছিল শাসকদলের বিরুদ্ধে। ‘কুইক রেসপন্স টিম’ গিয়েই লাঠিচার্জ করে শিবির সরিয়ে দেয়। এই বিধানসভার ২২৮টি বুথে এজেন্টদের ভয় দেখানোর অভিযোগ করেছে বিরোধীরা। তেতরালে সিপিএম বুথ এজেন্ট শেখ নাসিরুদ্দিনকে মেরে বুথ থেকে বের করে দেওয়া বলে অভিযোগ। এলাকার সিপিএম নেতা ও প্রাক্তন বিধায়ক সুভাষ মণ্ডলের দাবি, ‘‘ভোটের আগের দিন রাতে রাধামোহনপুর, মোহনপুরের মতো নানা জায়গায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে তৃণমূল ভয় দেখিয়েছে।’’ বিজেপির জেলা সভাপতি সন্দীপ নন্দীর দাবি, ‘‘জেলার সব জায়গায় আমাদের এজেন্টদের বাধা দেওয়া হয়। এরুয়ার, নবাবনগরে বিজেপি কর্মী ও এজেন্টদের গৃহবন্দি করে রাখা হয়।’’ তৃণমূল নেতা বনমালী হাজরার পাল্টা, ‘‘ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে। বিরোধীরা এজেন্ট দিতে না পেরে ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
ভেদিয়া অঞ্চলের সাঁতলা গ্রামের ৫৭ নম্বর বুথে বিজেপি তৃণমূলের ঝামেলায় এককড়ি মাজি নামে এক বিজেপি কর্মীকে মারধর করে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। পাল্টা মারের অভিযোগ করেছে তৃণমূল। আউশগ্রাম ১ ব্লকের উক্তা অঞ্চলের পিচকুড়ি গ্রামের বুথে বিজেপির এজেন্ট তাপস হালদারকে মারধর করে বের করে দিয়ে ছাপ্পা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। দিগনগরের মালিদাপাড়া, দক্ষিণপাড়াতেও মারের অভিযোগ উঠেছে। বিজেপির অভিযোগ, দক্ষিণপাড়ার প্রায় ৩০০ জন ভোট দিতে পারেননি। মঙ্গলকোটের মাজিগ্রাম অঞ্চলের চারটি বুথে বিজেপি, কংগ্রেসের এজেন্টকে বসতে না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ধারসোনা ও গোতিষ্ঠা অঞ্চলের তিনটি বুথে সিপিএমকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। কাটোয়ার চরপানুহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়েও বিজেপি, তৃণমূলের মধ্যে অশান্তি হয়। বারোয়ারিতলার বুথে বিজেপির এজেন্ট কৌশিক চট্টোপাধ্যায়কে মারধর করে বুথে বসতে না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলকোটের বকুলিয়াতেও বিজেপি কর্মী চন্দন মণ্ডলকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। ঝিলু, ক্ষীরগ্রামেও বিজেপি এজেন্টকে বুথে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ।
সোমবার সকাল থেকে গাড়ি নিয়ে এলাকায় ঘুরে কর্মীদের কাছে ভোট কেমন হচ্ছে খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন তৃণমূলের গলসি ১ ব্লক সভাপতি জাকির হোসেন। সঙ্গে ছিলেন জেলা পরিষদের সদস্যা নূরন্নেশা বেগম। বামুনাড়া গ্রামে তাঁদের গাড়ি আটকে হেনস্থা করার অভিযোগ উঠেছে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। কংগ্রেসের পাল্টা, তৃণমূলের কোন্দলেই এই ঘটনা। মাড়ো গ্রামের চারটি বুথের মধ্যে পোলিং এজেন্টদের বসতে দেওয়া হয়নি বলে বিজেপির অভিযোগ। দুপুরে এ নিয়ে সংঘর্ষে দু’দলের সাত জন আহত হন। গলসি স্টেশন বাজার এলাকায় এক বিজেপি কর্মীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। ওই কর্মী মুড়ি, ঘুগনি ও লাড্ডু বিলিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করছিল বলে তৃণমূলের অভিযোগ।
বর্ধমান শহরের বাবুরবাগ সিএমএস হাইস্কুলে বিরোধী এজেন্ট তো বটেই ভোটারদেরও মারধর করার অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার পরে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা এলাকার কাউন্সিলরকেও তাড়া করে বলে অভিযোগ। বিরোধীদের দাবি, সাধনপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ভেতরে থাকা দুটি বুথ, নীলপুর, পুলিশ লাইন-সহ শহরের প্রায় ১৫টি বুথে এজেন্ট ছিল না। রায়নার হিজলনা অঞ্চলের বেশ কয়েকটি বুথ, নতু, নাড়ুগ্রাম, মুগরা, উচালনেও একই অভিযোগ। সিপিএম, বিজেপির দাবি, বিভিন্ন গ্রামে সকালের দিকে বুথ দখল করতে গেলে গ্রামবাসীরা বাধা দেন। বর্ধমান উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের কলসা গ্রামে গ্রামবাসীরা এককাট্টা হয়ে প্রতিরোধ করে। রায়নার পহলানপুর, পলসোনাস মেমারির বিজু ২-এর আতাপুর, বড় পলাশনেও প্রতিরোধ হয়। মেমারির ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে ভোরে লোকজন জড়ো করে তৃণমূলের পার্টি অফিস ভেঙে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। তরুণ মুখোপাধ্যায় নামে এক জন আহত হন। তিনি বিজেপির নামে থানায় অভিযোগ করেছেন। সিপিএমের অভিযোগ, রায়নার মুক্তিপুরে তাঁদের এক কর্মীর পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ভোটগ্রহণ পর্বের শেষ দিকে বুথ দখল করতে চেয়ে জামালপুরের জৌগ্রামে তেলেনুড়ি গ্রামে তৃণমূল-বিজেপি গোলমাল বাধে বলে অভিযোগ। দু’রাউন্ড কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে পুলিশ।
বিজেপি প্রার্থী সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত, পুরসভায় মানুষকে ভোট দেওয়ার অধিকার দেয়নি তৃণমূল। এ বারে সকাল সকাল পোলিং এজেন্টদের তুলে দিয়ে ভোট লুটের চেষ্টা চালায়। কিন্তু আমাদের কর্মীরা রুখে দাঁড়ান। প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় বাহিনী যথাযথ ভূমিকা পালন করেছে। সে জন্য খুব কম বুথে ছাপ্পা মারতে পেরেছে তৃণমূল।’’ সিপিএমের জেলা সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিক বলেন, ‘‘২০১১ সাল থেকে যে ভাবে ভোট করাচ্ছে তৃণমূল এ বারেও তাই করেছে। তবে প্রতিরোধ হয়েছে। যেখানে তা হয়নি সেখানে ভোট লুট হয়েছে।’’
তৃণমূলের জেলা সভাপতি স্বপন দেবনাথের দাবি, ‘‘ বিরোধীরা কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। দিনের শেষে মানুষই ভোট দিয়েছেন।’’