প্রতি পুরভোটে পাশা উল্টে যাচ্ছে। যে কোনও দলের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকাটাই যখন এ রাজ্যে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, দাঁইহাটের কুর্সিতে কেউই একটানা বেশি দিন টিঁকতে পারছে না। বড জোর পাঁচ বছর, তা-ও যদি মাঝপথে অকালপতন না হয়।
দাঁইহাট পুরসভায় একের পর এক ভোটের ফলাফল নজর করলে দেখা যাবে, বোর্ড পাল্টে দেওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সাল থেকেই। সে বছর সিপিএম ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। মাত্র এক বছরের মাথায় সিপিএমের পুরপ্রধান ভীষ্মদেব ভক্তকে সরিয়ে দিয়ে কংগ্রেসের সমর্থনে বিক্ষুব্ধ সিপিএমের মৃত্যুঞ্জয় রক্ষিত পুরপ্রধান হয়েছিলেন। সেই বছর দশ আসনের পুরসভা সিপিএম ও কংগ্রেস পাঁচটি করে আসনে জয় পেয়েছিল। নিয়ম মেনে, টস করে সিপিএম পুরবোর্ডে এসেছিল। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারে নি।
১৯৯৫ সালে দাঁইহাটে আসন সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪টি। সে বছর কংগ্রেস ১২টি আসন পেয়ে ক্ষমতায় আসে, তীব্র গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মধ্যেও পাঁচ বছর কোনও রকমে ক্ষমতায় টিকে থাকে। ২০০০ সালে কংগ্রেসের পুরপ্রধান মদন দে ভোটে হেরে গেলেও দাঁইহাটে ১৪টি আসনের মধ্যে ৯টিতে জিতে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে। কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যে কংগ্রেসের পুরপ্রধান সন্তোষ দাসকে সরিয়ে সিপিএমের সমর্থনে বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস কাউন্সিলর কালিদাস রায় পুরপ্রধান হন। বেশ কয়েক মাস পরে সিপিএম কালিদাসবাবুর উপর থেকে সমর্থন তুলে নেয়। সেই সময় বিরুদ্ধে ১৩ জন কাউন্সিলর থাকা সত্ত্বেও টানা ১৪ মাস কালিদাসবাবু দাঁইহাটের পুরপ্রধান ছিলেন।
২০০৫ সালে ৯টি আসন পেয়ে সিপিএম দাঁইহাট পুরসভা দখল করে। ২০১০ সালে সিপিএম ভেবেছিল, গোটা রাজ্যে তৃণমূলের হাওয়া উঠলেও দাঁইহাট তাদেরই থাকবে। তখনও বামেরা ক্ষমতাসীন। আর কিছু না হোক, উন্নয়নের কথা ভেবেই মানুষ তাদের ভোট দেবেন। কিন্তু দেখা গেল, কংগ্রেস ও তৃণমূল জোট ৯টি আসন পেয়ে পুরবোর্ড দখল করেছে। আর পাঁচটি আসন পেয়ে বিরোধী আসনে সিপিএম। এই বোর্ডের শেষ কয়েক মাস কংগ্রেস আর তৃণমূলের সম্পর্ক দাঁড়িয়েছিল ‘সাপে-নেউলে’। তৃণমূল সমর্থন তুলে নেওয়ায় সংখ্যালঘু হয়ে কংগ্রেসকে বোর্ড পরিচালনা করতে হয়। এ বারও সেই জয়ের অঙ্ক ৯-৫ রেখেই পাশার দান উল্টে গেল, ফের লাল পতাকা উড়ছে দাঁইহাটে।
দাঁইহাটের তৃণমূলের এক নেতা বলেন, “আমাদের খুব আশা ছিল, এ বার দাঁইহাটে নিশ্চিত ভাবে তৃণমূলের বোর্ড হবে। রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় রয়েছে, সে জন্য মানুষ আমাদের ভোট দেবেন ভেবেছিলাম। কিন্তু চুপিসাড়ে দই খেয়ে গেল সিপিএম।” ঠিক যেমন ২০১০ সালে সিপিএম ভেবেছিল, এবং ঠকেছিল। তখনকার এক বাম কাউন্সিলরের কথায়, “সে বার পুরমন্ত্রী দাঁইহাটে এসে উন্নয়নের বার্তা দিয়েছিলেন। আমাদের প্রচারের ধারে-কাছেও ছিল না বিরোধীরা। তা সত্ত্বেও আমরা হেরেছিলাম।”
দাঁইহাটে ঘন-ঘন পট পরিবর্তনের আসল কারণটা তবে কী? প্রবীণেরা বলছেন, ভোট কাটাকাটি যদি একটা প্রধান কারণ হয়, আর একটা বড় কারণ পরিষেবা পাওয়া বা না পাওয়া নিয়ে শহরবাসীর সচেতন থাকা এবং সেই মতো ভোট দেওয়া।
তৃণমূল নেতা রঞ্জিত সাহা এবং কংগ্রেস নেতা সন্তোষ দাসের মতে, “এক বার দক্ষিণপন্থী ভোট এক হয়েছে তো পরের বার ভাগ হয়ে গিয়েছে। আর তার জন্যই বারবার পরিবর্তন ঘটেছে।” সিপিএম নেতারা মুখে তা স্বীকার না করলেও এই ভোট ভাগের হিসেব পুরো উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও তাঁদের নেই।
ভোটের হিসেব বলছে, শহরের ৩, ৪, ৫ ও ১২— এই চারটি ওয়ার্ড কোনও দিন বামেদের দখলে যায়নি। ভবিষ্যতেও যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বাকি দশ আসনে সিপিএমের লড়াই। সেই আসনগুলি থেকে যে বার তারা বেশি ফসল তুলতে পারে, সেই বার ক্ষমতায় আসে। এ বার যেমন ২ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়া বাকি সব সিপিএমের দিকে গিয়েছে। এর মধ্যে ১, ৭, ৮, ৯, ১০ ও ১৩— ছয় আসনে কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে ভোট কাটাকাটিতে সিপিএম এগিয়ে গিয়েছে। ২০০০ ও ২০১০ সালে কংগ্রেস ও তৃণমূল জোট করেই ক্ষমতা পেয়েছিল। সেই জোট ভেঙে যাওয়ায় বামেরা সুবিধা পেয়ে গিয়েছে।
দাঁইহাটের প্রবীণ বাসিন্দা, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের গৌরাঙ্গ মণ্ডলের মতে, “জোট থাকা কিংবা না-থাকার উপরে যেমন দাঁইহাটে জেতা নির্ভর করেছে, তেমনই ক্ষমতায় এসে প্রত্যাশা পূরণ না করার কথাও দাঁইহাটের মানুষ মনে রেখেছেন। পরের বার সেই মতো ভোট দিয়েছেন।” শবশিব পাড়ার মৃত্যুঞ্জয় রক্ষিতও মনে করেন, “পুরবোর্ড কী রকম কাজ করছে, সেই দিকে নজর রেখেই ভোট দিয়েছেন দাঁইহাটের মানুষ। তাই এত বদল।”