‘স্টেট অ্যাচিভমেন্ট সার্ভে’ আয়োজিত হচ্ছে। বর্ধমান ২ ব্লকের রামনারায়ণ শশীভূষণ বিদ্যাপীঠে। নিজস্ব চিত্র।
কেউ দু’মাস স্কুলে আসছে না। কেউ তিন মাস। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির এই সব পড়ুয়ারা কেন আসছে না, তা খোঁজ নিতে গিয়ে বিবিধ কারণ জানতে পারলেন কালনার স্কুল কর্তৃপক্ষ। কেউ বাড়িতে সমস্যার মাঝে স্কুলে আসা বন্ধ করেছে, কেউ আবার বাবা-মা কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পরে আর স্কুলের রাস্তা ধরছে না— এমন নানা বিষয় উঠে এসেছে বলে জানিয়েছেন ওই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। বাড়ি গিয়ে তাদের স্কুলে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন অম্বিকা মহিষমর্দ্দিনী উচ্চ বিদ্যালয় (উচ্চ মাধ্যমিক) কর্তৃপক্ষ।
স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, সাধারণত নবম শ্রেণির পর থেকে পড়ুয়াদের মধ্যে স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। সম্প্রতি কালনা শহরের স্কুলটি জানতে পারে, তিন শ্রেণির ২০ জন পড়ুয়া নিয়মিত স্কুলে আসছে না। যার মধ্যে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণির ১৪ জন। তাদের বেশির ভাগের বাড়ি প্রত্যন্ত এলাকায়। তারা স্কুলের পোশাকও নেয়নি। পড়ুয়াদের বাড়ি গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বুঝতে পারেন, অভিভাবকদের একাংশ পড়ুয়াদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে উদাসীন।
শিক্ষকেরা জানান, বালিরবাজার এলাকায় একটি ছাত্রের ঠাকুমা জানিয়েছেন, ছেলে নানা নেশায় আশক্ত হওয়ার কারণে পুত্রবধূ বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন। বাড়ির এমন পরিবেশে নাতি আর পড়তে চাইছে না। আবার, বাবা পরিযায়ী শ্রমিক, মা পরিচারিকার কাজ করেন— এমন একটি পরিবারের পড়ুয়াও স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। স্কুলে না আসা ছাত্রদের অনেকের সঙ্গে কমেছে বইয়ের যোগাযোগ। তাদের খেলাধুলো, মোবাইল দেখে দিন কাটছে।
হাটকালনা পঞ্চায়েতের রংপাড়ার তিন ভাই এই স্কুলের পড়ুয়া। তাদের বাবা পেশায় কাঠের মিস্ত্রি। তিনি জানান, বড় ছেলে দশম শ্রেণিতে পড়লেও গেঞ্জির কারখানায় কাজ করে। পরীক্ষার সময়ে সে স্কুলে যায়। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র দুই ছেলেকে স্কুলে যেতে বললেও, মাস দুয়েক ধরে যেতে চাইছে না। নতুন বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রের মা আবার জানান, ছেলে ভাল করে পড়তে পারে না। তার মধ্যে সে নিয়ে ভয় কাজ করে। শিক্ষকেরা আশ্বাস দেওয়ার পরে ছেলে ফের স্কুলে যাবে, আশায় তিনি। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রশান্ত রায় বলেন, ‘‘ওরা কেন স্কুল আসছিল না, তা আমরা জানতে পেরেছি। স্কুলের তরফে অভিভাবকদের বোঝানোর পরে ভাল সাড়া মিলেছে।’’ তাঁর দাবি, যে ছাত্রেরা কিছু দিন স্কুলে আসবে না, এখন থেকে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাদের বাড়িতে যাবেন।
জেলার শিক্ষক মহলের একাংশের দাবি, এমন সমস্যা রয়েছে অনেক স্কুলেই। পাশ-ফেল পদ্ধতি না থাকার কারণে অনেক অভিভাবক ছেলেমেয়েকে নিয়মিত স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে উদাসীন। যার ফলে আচমকা স্কুল ছাড়ার পরে কেউ শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। অনেকে অল্প বয়সেই ভিন্ রাজ্যে কাজে যাচ্ছে। জেলার রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক অরূপ চৌধুরী বলেন, ‘‘পঞ্চম, ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়াদের একাংশ স্কুলে আসা বন্ধ করলে আরও গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করা উচিত। স্কুলছুট রোখার ক্লাব তৈরি হলে সমস্যা অনেকটাই কমানো যাবে।’’ স্কুলছুট নিয়ে কাজ করে ২০১৯ সালে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন বর্তমানে জয়নগর উত্তর কেন্দ্রের স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা কৃষ্ণেন্দু ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘স্কুলে কোনও পড়ুয়া সপ্তাহখানেক না এলেই তার ক্লাসের বন্ধুদের নিয়ে খোঁজ নেওয়া দরকার। প্রয়োজনে দ্রুত তাদের বাড়ি যেতে হবে। দেরি করলে পড়াশোনা থেকে ছাত্র যেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তেমনই অভিভাবকদের পড়াশোনার গুরুত্ব বোঝানোও কঠিন হয়ে যায়।’’