মূর্তি গড়ার কাজ চলছে মন্দিরে। —নিজস্ব চিত্র।
অমাবস্যা পড়তেই মন্দিরের ঈশান কোনে জ্বলে ওঠে তিনটি প্রদীপ। সেই প্রদীপের কালিতেই রাঙানো হয় দেবীর অঙ্গ। মন্তেশ্বরের খরমপুর গ্রামের ক্ষেপিমার পুজোয় এ রেওয়াজ কয়েক’শো বছরের।
কুসুমগ্রাম পঞ্চায়েতের ছোট এ গ্রামের পরিচিতি এই কালীপুজোর হাত ধরেই। ১৮ ফুটের এই কালীমূর্তি মন্তেশ্বর ব্লক জুড়েই ভুসোকালী বা শ্যামাকালী নামে পরিচিত। গ্রামবাসীরা জানান, প্রতি বছরই কালীপুজোর সময় দেবীর মাটির মূর্তি তৈরি হয়। গ্রামের প্রচলিত প্রথা মেনে অন্য দেবদেবীর পুজোও করেন না গ্রামবাসীরা।
কালীপুজোর সঙ্গে এ গ্রামে জড়িয়ে রয়েছে আর একটি রেওয়াজও। গ্রামের সব বাড়িই একতলা। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, দেবী যেহেতু একতলায় থাকেন, তাই সিঁড়ি বেয়ে কেউ উপরে উঠলে দেবী রুষ্ট হন। কিছু বাড়িতে চিলেকোঠা অবশ্য আছে। তবে সেখানেও মই বা অন্য কোনও ভাবে ওঠা হয়। এ প্রসঙ্গে গ্রামের এক বাসিন্দা কালাচাঁদ ঘোষ বলেন, “বছর দশেক আগে আমার জ্যাঠা নিজের বাড়িতে সিঁড়ি করে উপরে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু যে দিন সিঁড়ি ঢালাই হয় সেদিনই বাড়িতে আচমকা বাজ পড়ে দেওয়াল ফেটে যায়। এরপর থেকে আর কেউ সিঁড়ি তৈরি করার কথা ভাবেনি।”
মোরাম বিছানো সরু রাস্তা ধরে গ্রামে ঢুকে কয়েক পা হাঁটতেই চোখে পড়ে ৫৭ ফুট উঁচু কালী মন্দির। সেখানে জোরকদমে চলছে মূর্তি গড়ার কাজ। মন্দিরটি আগে খড়, করগেটের ছাউনির ছিল, তবে ২০০০ সালের বন্যার পরে গ্রামের মানুষ একজোট হয়ে নতুন কংক্রিটের মন্দির গড়েন। গ্রাম ঘুরে দেখা গেল, ইতিমধ্যে বেশ কিছু বাহারি আলো বসে গিয়েছে রাস্তায়। মাইক ও বাজনার বরাত দেওয়ার কাজও প্রায় শেষ। গ্রামবাসীরা জানালেন, আত্মীয় স্বজনেরাও আসতে শুরু করতে দিয়েছেন বেশ কিছু বাড়িতে।
কথিত রয়েছে, বহু বছর আগে যবগ্রাম এলাকা থেকে এক সাধু এ গ্রামে এসে দেবীর পুজা শুরু করেন। গ্রামের এক পরিবার দেবীর পুজোয় সে সময় কিছু ভূসম্পত্তি দান করেছিলেন। তবে বর্তমানে সে সব কিছুই নেই। গ্রামের বাসিন্দাদের চাঁদাতেই চলে পুজোর খরচ। নিয়ম মেনে লক্ষ্মীপুজার পরেই প্রতিমার তৈরির কাজ শুরু হয়। অল্প দিনে বিশালাকার প্রতিমা শুকোতে হয় বলে ব্যবহার করা হয় হ্যালোজেনের আলো। তাতেও পুজোর দিন গভীর রাতে শেষ হয় মূর্তি তৈরি। রাতেই মাটির পাত্রে প্রদীপ শিখা থেকে জমা কালি নিয়ে রাঙানো হয় প্রতিমার শরীর। তারপর গয়না পরিয়ে চক্ষুদান করেন শিল্পী। নিয়ম অনুযায়ী, চক্ষুদানের পরে শিল্পী আর দেবীর মুখ দেখতে পারেন না। গ্রামের নাড়ুগোপাল চন্দ্র, সুশীলকুমার দে, মহাদেব কুণ্ডুরা জানান, এ ক্ষেত্রে শিল্পীকে পিছু হেঁটে চলে যেতে হয় গ্রামের কোনও রাস্তার মোড়ে। সেখান থেকে ফিরে অবশ্য তিনি প্রতিমা দর্শন করতে পারেন। প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ পুজো শুরু হতে রাত প্রায় ভোর হয়ে যায়। এরপর বেলা ১১টা পর্যন্ত টানা চলে দেবীর আরাধনা। পুজো চলাকালীন পাঁঠাবলিও হয়। রাতে মন্দিরের পাশে গাগর পুকুরে দেবীর বিসর্জন হয়। বাসিন্দাদের দাবি, গ্রামের একমাত্র উত্সবে সামিল হন আশপাশের হাজারো মানুষ।