পারাজে ধান বিক্রি করেও টাকা মেলেনি, রসিদ দেখিয়ে এই অভিযোগ করলেন বেশ কিছু চাষি।—নিজস্ব চিত্র।
চালকলের বর্জ্য মেশা জল আর ছাইয়ে ধানের ক্ষতি হচ্ছে বলে আগেই অভিযোগ করেছিলেন চাষিরা। তাঁদের দাবি ছিল, গ্রামের সমস্ত চাষির ধান সহায়ক মূল্যে কিনে নিতে হবে ওই ৯টি চালকলকে। কিন্তু ধান নেওয়ার এক মাস পেরিয়ে গেলেও চালকল মালিকেরা এক টাকাও দেননি বলে অভিযোগ পারাজের ওই চাষিদের। সোমবার অভিযোগ জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রীকে চিঠি পাঠান তাঁরা। চিঠির প্রতিলিপি দেওয়া হয় জেলাশাসক ও খাদ্য নিয়ামককেও। খাদ্য নিয়ামক সাধনকুমার পাঠকের দাবি, ‘‘ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ চার দিন ধরে বন্ধ থাকা গলসির ৪৩টি চালকল নিয়েও এ দিন খাদ্য দফতরে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠিয়েছেন তিনি। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ফড়েদের ধরা না হলে চালকল খোলা হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মালিকেরা।
সোমবার দুপুরে পারাজ গ্রামের ওই চাষিরা লিখিত অভিযোগে জানিয়েছেন, গলসি ১ ব্লকের ৯টি চালকলের বর্জ্য মিশ্রিত দূষিত জলে সেচ খালের জল চাষের অযোগ্য হয়ে উঠছে। ফলে ওই জমির ফসলও বাড়ি নিয়ে যেতে পারছেন না চাষি। তার উপর চালকলের ছাইয়েও ধানের ক্ষতি হচ্ছে। মহম্মদ হোসেন মণ্ডল, তাবিবুর রহমান মণ্ডল, আবু সুফিয়ান মণ্ডল নামে ওই চাষিদের আরও দাবি, ‘‘বারবার গ্রামবাসীরা অভিযোগ জানানোয় ওই চালকল মালিকরা পারাজ গ্রামের সমস্ত চাষির ধান সহায়ক মূল্যে কিনবেন বলে মৌখিক আশ্বাস দেন। সেই মতো চাষিরা চালকলে ধান বিক্রিও করেন।’’ তাঁদের অভিযোগ, ‘‘মালিকেরা জানিয়েছিলেন, তিন-চার কিস্তিতে ওই টাকা শোধ করা হবে। কিন্তু এক মাস হয়ে গেলেও মালিকরা এক টাকাও আমাদের দেননি।” যদিও চালকল মালিক সমিতির সহ-সভাপতি আব্দুল মালেকের দাবি, “গ্রামের সমস্ত চাষির ধান সহায়ক মূল্যে কেনার ক্ষমতা সরকারেরও নেই, তো চালকল কিনবে কী ভাবে? ধান বিক্রি করেছেন এমন প্রমাণ চাষিরা দেখাতে পারলে মালিক তার দাম নিশ্চিত ভাবে দিয়ে দেবেন।”
এ দিকে, গত বৃহস্পতিবার গলসির পারাজ গ্রামের কাছেই একটি চালকলে কোনও রকম টোকেন ছাড়া প্রচুর ফড়ে ধান কেনার দাবি জানায়। চালকল ফিরিয়ে দিতেই শুরু হয় পরপর তিনটি কলে হামলা। একটি চালকলের ভিতর ঢুকে গাড়ি থেকে নামিয়ে অশোক অগ্রবাল নামে এক মালিককে ফড়েরা মারধর করে বলেও অভিযোগ। এরপরেই নিরাপত্তার অভাবের অভিযোগ তুলে গলসি ১ ব্লকের ২১টি চালকল বন্ধ করে দেন মালিকরা। পরের দিন বন্ধ হয় আরও ২২টি চালকল। রবিবার বর্ধমান জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ বৈঠকে প্রশাসনের তীব্র সমালোচনা করেন সদস্যরা। তাঁদের অভিযোগ, গত মাসের ১৪ তারিখ থেকে সহায়ক মূল্যে ধান কেনা শুরু হয়েছে। চাষিদের নাম করে ফড়েরা বারবার চালকলের সামনে হামলা চালিয়েছে, রাস্তা কেটে দিয়েছে। কিন্তু চালকলের ভিতরে ঢুকে হামলা চালানোর সাহস পায়নি। কিন্তু এ বার সে ঘটনাও ঘটে গেল। চালকল সমিতির কার্যকরী এক কর্তার অভিযোগ, ‘‘প্রশাসনের নিষ্ক্রীয়তার জন্য ফড়েরা চালকলের ভিতর ঢুকে কর্মীদের ও মালিককে মারধর করল, চালকলে ভাঙচুর চালাল এরপরেও কিছু না করলে তো প্রাণে মেরে দিয়ে চলে যাবে।”
ওই সমিতির সদস্যেরাই জানান, মে মাসে পারাজ ও আশপাশের গ্রামের চাষিদের নাম করে বেশ কয়েকজন ফড়ে সহায়ক মূল্য ধান কেনার জন্য চালকল কর্মীদের উপর অত্যাচার করে। তারপরে ১২ জনের নামে নির্দিষ্ট ভাবে গলসি থানায় অভিযোগও করা হয়। কিন্তু প্রশাসনের তরফে আশ্বাস ছাড়া কিছুই মেলেনি। সমিতির সহকারী সম্পাদক সালেম মণ্ডল বলেন, “বিভিন্ন চালকলে যে ভাবে একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে, তাতে চালকল বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। কর্মীদের নিরাপত্তার জন্যই চালকল বন্ধ রাখতে হয়েছে।” এ ছাড়াও গলসি ১ ও ২ ব্লক ইউনিটে ২০১৪-১৫ সালের বকেয়া লেভির টাকা ফেরত, লেভি আদায়ের ব্যবস্থা ও কিসান মান্ডি থেকে সরকারকে সরাসরি ধান কেনার ব্যবস্থা করারও দাবি জানিয়েছেন সমিতির সদস্যেরা। তবে বর্ধমান জেলার খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ মহম্মদ ইসমাইলের দাবি, ‘‘লেভির বকেয়া টাকা কল মালিকদের কাছে ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়েছে। আর চাষিদের থেকে নেওয়া টোকেন দেখালে আমরা নিয়মমাফিক লেভি নেব।”
ওই চালকলগুলি বন্ধের কারণ নিয়েই সোমবার জেলা খাদ্য নিয়ামক রাজ্য খাদ্য দফতরে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। খাদ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, রিপোর্টে জানানো হয়েছে, যে টোকেন ছাড়াই চাষির নাম করে কয়েক জন বিভিন্ন চালকলে হামলা চালিয়েছে। সে জন্য মালিকরা চালকল বন্ধ রেখেছেন। গত চারদিন ধরে লাগাতার মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চালকল খোলার জন্য চাপ দেওয়া হলেও অভিযুক্তরা গ্রেফতার না হলে চালকল খুলবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলা হয়েছে রিপোর্টে। বর্ধমান চালকল মালিক সমিতি প্রচারপত্র ছাপিয়েও বিলি করেছে। খাদ্য নিয়ামকের আশা, “রিপোর্ট পাওয়ার পরেই মঙ্গলবার থেকে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে।” যদিও চালক মালিক সমিতির সহ সভাপতি আব্দুল মালেক বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, “আমরা প্রশাসনের কাছ থেকে কোনও রকম সাড়া পাইনি। তবে খাদ্য নিয়ামক যদি ওই রিপোর্ট দেন, তাহলে আমরা যে এতদিন ধরে ঠিক কথা বলছিলাম, তা প্রশাসন মেনে নিল।”