প্রহ্লাদ হালদার। নিজস্ব চিত্র
বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। তবে এই বয়সেও তিনি অনায়াসে জলে ডুবে থাকতে পারেন মিনিট চারেক। জলের গভীরে নেমে দ্রুত এক জায়গা থেকে পৌঁছে যান অন্যত্র। ভাগীরথীতে কেউ তলিয়ে গেলে সবার আগে ডাক পড়ে তাঁরই। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বিনা পারিশ্রমিকে নদীতে তলিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করছেন পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলী ২ ব্লকের পাটুলির প্রহ্লাদ হালদার। প্রতিবেশীদের দাবি, এখনও পর্যন্ত ভাগীরথী থেকে ৩০টির বেশি দেহ তুলে এনেছেন তিনি। তবে এ কাজের পারিশ্রমিক না হোক প্রাপ্য সম্মানটুকুও পাননি তিনি। প্রহ্লাদ অবশ্য বলেন, ‘‘যত রাতই হোক, কেউ ডাকলে ফেরাতে পারি না।’’
পাটুলির হালদার পাড়ায় মাটির দেওয়াল, টালির ছাউনি দেওয়া বাড়ি তাঁর। বর্ষায় টালি দিয়ে জল ঝরে বলে চালে বিছানো রয়েছে ত্রিপল। কাকভোরে উঠে নদী থেকে মাছ ধরা প্রহ্লাদের পেশা। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পেশায় মৎস্যজীবী হলেও, ডুবুরি হিসাবে তাঁর খ্যাতি রয়েছে। ভাগীরথীতে কেউ স্নান করতে নেমে তলিয়ে গেলে বা নৌকাডুবির মতো ঘটনা ঘটলে খোঁজ পড়ে তাঁরই। কয়েক মাস আগে চুপি পাখিরালয়ে নৌকা উল্টে দুই পর্যটক নিখোঁজ হন। তাঁদের খুঁজতে আসেন দুর্যোগ মোকাবিলা দলের সদস্য, ডুবুরিরা। তাঁরা বিফল হওয়ায় জলে নামানো হয় ৫৯ বছরের প্রহ্লাদকে। ভাগীরথীর প্রায় ৩০ ফুট নীচ থেকে এক জনের দেহ তুলে আনেন তিনি। প্রহ্লাদ বলেন, ‘‘অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়া এখনও আমি অনায়াসে একেবারে নদীর তলায় নেমে যেতে পারি। চুপির ছাড়িগঙ্গায় রাতে জলের তলায় মাটি ঘেঁষে যেতে যেতে আমার শরীরে ঠেকে দেহটি। দ্রুত উপরে উঠে মিনিট পাঁচেক শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে আবার জলে নামি। তার পরেই তুলে আনি দেহটা।’’
২০১৯ সালে মামদুপুর ঘাটে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভাগীরথীতে পড়ে গিয়েছিল একটি টোটো। চালক বেঁচে গেলেও, তলিয়ে যান এক বৃদ্ধা নিভারানি গোস্বামী। ভাগীরথীর প্রায় ৪০ ফুট নীচে নেমে তাঁর দেহ খুঁজে আনেন প্রহ্লাদ। জলের তলায় থাকা টোটোটির সঙ্গে দড়ি বেঁধে আসেন। সেটির সাহায্যেই তোলা হয় টোটোটিকে। বছর চারেক আগে পাটুলির ঘাটে স্নান করতে নেমে তলিয়ে যায় এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। তার দেহও খুঁজে আনেন প্রহ্লাদ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বছর দেড়েক আগে দামপাল ঘাটে তলিয়ে যাওয়া ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক ছাত্র, ছ’বছর আগে মামুদপুর ঘাটে স্নান করতে নেমে তলিয়ে যাওয়া চার জনের দেহ খুঁজে আনার মতো কাজ অজস্র বার করেছেন প্রহ্লাদ। পাটুলির বাসিন্দা দ্বারকানাথ দাস বলেন, ‘‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষিত ডুবুরি, বিপর্যয় মোকাবিলা দলের সদস্যেরা ব্যর্থ হলে ডাক পড়ে ওঁর। জল থেকে ঠিক খুঁজে বার করে আনেন দেহ।’’ বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘কেউ ভাগীরথীতে তলিয়ে গেলে আমাদের ওঁর কথা মনে পড়ে। সরকারি ডুবুরি দেহ খুঁজে না পেলেও, উনি ঠিক তুলে আনেন। ওঁকে সম্মানিত করার আর্জি জানাব জেলা প্রশাসনের কাছে।’’
হালদার পরিবারের সদস্যেরা জানান, বহু বছর ধরে নিঃস্বার্থ ভাবে এ কাজ করেও কোনও অর্থ বা সম্মান জোটেনি প্রহ্লাদের। তিনি নিজে বলেন, ‘‘কেউ কোনও দিন এই কাজের জন্য কোনও সম্মান দেননি। তবে কাউকে খোঁজার জন্য ডাক পড়লে ফেরাতে পারি না। ভাবি, জলের তলায় নিখোঁজ হয়ে যাওয়া প্রিয়জনকে শেষ বার তাঁর পরিবারের সদস্যেরা দেখবে না!’’ তিনি জানান, আগে পাঁচ মিনিট অবলীলায় জলে ডুবে থাকতে পারতেন। বয়স বাড়ায় সেই ক্ষমতা খানিকটা কমেছে। প্রাণের ঝুঁকিও থাকে। ধরা গলায় প্রহ্লাদ বলেন, ‘‘রাতে কেউ ডাকলে বাড়ির লোক পথ আটকায়। আমি নিজের কথা ভাবি না। ভাবি, মানুষ বিপদে পড়ে আমায় ডাকছে। যাওয়াটাই কর্তব্য।’’