আদিবাসী ভোটেই অঙ্ক কষছে দু’শিবির

তফসিলিদের মন কোন দিকে? আদিবাসীরাই কী ভাবছে— ভোটের আবহে আউশগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে এটাই প্রশ্ন সিপিএম, তৃণমূলের। এক দিকে, তৃণমূল নেতারা পাট্টা বিলি, তফসিলি জাতি-উপজাতিদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে সাহায্যের কথা বলছেন। গত কয়েক বছরে সিপিএম সমর্থক একাংশ আদিবাসীর ভয়ে কীভাবে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা ঘরছাড়া হয়ে রয়েছেন, সে কথা বলে ভোট ব্যাঙ্ক টানার চেষ্টা করছেন।

Advertisement

সৌমেন দত্ত

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৬ ০২:১৬
Share:

তফসিলিদের মন কোন দিকে? আদিবাসীরাই কী ভাবছে— ভোটের আবহে আউশগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে এটাই প্রশ্ন সিপিএম, তৃণমূলের।

Advertisement

এক দিকে, তৃণমূল নেতারা পাট্টা বিলি, তফসিলি জাতি-উপজাতিদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে সাহায্যের কথা বলছেন। গত কয়েক বছরে সিপিএম সমর্থক একাংশ আদিবাসীর ভয়ে কীভাবে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা ঘরছাড়া হয়ে রয়েছেন, সে কথা বলে ভোট ব্যাঙ্ক টানার চেষ্টা করছেন। উল্টো দিকে, পঞ্চায়েতের উপ-নির্বাচনের সময়কার সংঘর্ষ বা প্রতাপপুরের গোলমালের ক্ষত উস্কে দিয়ে হারানো ভোট ব্যাঙ্ককে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে চাইছে সিপিএম।

আউশগ্রামের মোট ভোটারের ৪৯ শতাংশ তফসিলি জাতিভুক্ত এবং ১৩ শতাংশ আদিবাসী। মূলত এই অংশের উপর ভর করেই ১৯৬৭ সাল থেকে এই আসন দখলে রেখেছে বামেরা। এমনকী, ১৯৭২ ও ২০১১ সালে বাম বিরোধী হাওয়ার মুখেও এই বিধানসভা কেন্দ্র বামেদেরই রয়ে গিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবারই ৫০ শতাংশের উপর ভোট পেয়ে আউশগ্রাম বিধানসভা থেকে জয়ী হয়েছেন বামেরা। এই কেন্দ্র থেকে পরপর ৬ বার জিতে বিধায়ক হন সিপিএমের শ্রীধর মালিক (১৯৭১, ১৯৭২, ১৯৭৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত)। ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত এই বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন সিপিএমের কার্তিকচন্দ্র বাগ। ২০০৬ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত বিধায়ক, এ বারের সিপিএম প্রার্থী বাসুদেব মেটে।

Advertisement

তার আগে ১৯৫৭ সালে অবশ্য আউশগ্রামে দুটি বিধানসভা কেন্দ্র ছিল। একটি সাধারণ ও অন্যটি তফসিলি জাতিভুক্তদের জন্য সংরক্ষিত। ওই বছর দুটি আসনেই জিতেছিল কংগ্রেস। পরের নির্বাচনে সাধারণ আসনটি উঠে যায়। ১৯৬২ সালে তফসিলিদের জন্য সংরক্ষিত আসনে জয়ী হন কংগ্রেসের কানাইলাল দাস। সেই শেষ। তারপর থেকে এই আসনটি আক্ষরিক অর্থে ‘বাম দুর্গ’ হয়ে উঠেছে।

সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য অচিন্ত্য মজুমদার বলেন, “এই এলাকার তফসিলি মানুষেরা তাঁদের উন্নতির জন্য আমাদের লড়াই ও সংগ্রামের কথা জানেন। আর আদিবাসীদের মর্যাদা তো বামফ্রন্ট সরকার দিয়েছে। এখনও তাঁদের উন্নতির জন্য আমাদের লড়াই চলছে। সে জন্যই ওই দুই সম্প্রদায়ের ভোট আমরা পেয়ে থাকি।”

সিপিএমর একাংশ কর্মীদেরও দাবি, আউশগ্রামে সিপিএম এতটাই শক্তিশালী, যে তাঁদের ভয়ে প্রতাপপুর এলাকায় তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা গ্রামছাড়া ছিলেন। আউশগ্রাম ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সৈয়দ হায়দার আলিকে অসহায় অবস্থায় বারেবারে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। কিছু দিন আগে পুলিশের উপস্থিতিতে প্রতাপপুরে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা গ্রামে ঢোকেন। আবার কয়েক মাস আগেও, পঞ্চায়েত উপ নির্বাচনের সময় আউশগ্রামে সিপিএম ও তৃণমূলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সিপিএম সমর্থিত আদিবাসীদের তির-ধনুকের সামনে পিছু হটেছিল তৃণমূলের মোটরবাইক-বাহিনী।

তবে দাবি যতই থাক, ২০১১ সালের ভোটের পরিসংখ্যান বলে, ‘বাম দুর্গ’ আউশগ্রামেও বামেদের প্রাপ্ত ভোট কমেছিল সে বার। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের থেকে ১৪ শতাংশ ভোট কমে সিপিএমের ভোট দাঁড়িয়েছিল ৫২ শতাংশে। প্রাপ্ত ভোট ছিল ৯০ হাজার ৮৬৩। আর কংগ্রেস ও তৃণমূল জোটের ১০ শতাংশ ভোট বেড়ে হয়েছিল ৩৮ শতাংশ। প্রাপ্ত ভোট ৬৭ হাজার ৭৬৭। তারপরেও অবশ্য সিপিএমের জয়ের ব্যবধান ছিল প্রায় তেইশ হাজার ভোট। লোকসভা নির্বাচনে অবশ্য পাশা উল্টে যায়। দেখা যায়, সিপিএমের ভোট ফের কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশে, আর তৃণমূলের ভোট বেড়ে হয়েছে ৪৫ শতাংশ। এর বাইরে রয়েছে বিজেপির ২০ হাজার ভোট। চূড়ান্ত তালিকায় দেখা যায় বিধানসভার সিপিএমের এগিয়ে থাকা টপকে তৃণমূল লোকসভায় ১৮ হাজার ৭২০ ভোটে জয়লাভ করে।

তাহলে কী ‘বাম দুর্গ’ আউশগ্রামে ভোট কমছে? অচিন্ত্যবাবুর দাবি, “লোকসভা বা পঞ্চায়েত নির্বাচন দেখে হিসেব কষলে ভুল হবে। ওই দুটো নির্বাচনে তো ভোট-লুঠ হয়েছে।” কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকে তৃণমূলের ভোট যে বেড়েছে, ত্বত্ত্ব-পরিসংখ্যানের সে হিসেব তো অস্বীকার করার উপায় নেই? অচিন্ত্যবাবু যদিও তা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, “দু’এক জন যে যাননি তা বলছি না, তবে তফসিলি জাতির মানুষ ও আদিবাসী মানুষ আমাদের সঙ্গেই রয়েছেন।”

সিপিএমের এই তথ্য মানছেন না আউশগ্রাম ১ ব্লকের তৃণমূল সভাপতি তথা ভাতার বিধানসভার প্রার্থী সুভাষ মণ্ডল। তাঁর কথায়, “ভাবের ঘরে চুরি করছে সিপিএম। তাঁরা ভাল করেই জানে তফসিলি ও আদিবাসীরা এক হয়ে আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। মিটিং-মিছিলে যোগ দিচ্ছেন।” আউশগ্রামের এ বারের তৃণমূল প্রার্থী অভেদানন্দ থান্ডারকে পাশে নিয়ে তৃণমূল নেতা টগর শেখও বলেন, “আদিবাসীদের জন্য জাহের থানের পাট্টা, তফসিলি সম্প্রদায়ের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের ব্যবস্থা করেছে তৃণমূল সরকার। তাঁরাও সিপিএমের ছেড়ে তৃণমূলে ভিড়ছেন।”

যদিও অচিন্ত্যবাবুর পাল্টা প্রশ্ন, “আদিবাসী শিল্পীদের নিয়ে গিয়ে দলীয় সভায় অনুষ্ঠান করানো মানে কী তাঁরা তৃণমূলে চলে গেল?”

উত্তর অবশ্য দেবে ভোটবাক্স।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement