আজ বুথে নেই কাটোয়া

এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে কাটোয়া মহকুমার পাঁচ ব্লকের ৬৩৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ১৩৪টি পঞ্চায়েত সমিতি ও ১১টি জেলা পরিষদের আসনই বিরোধীশূন্য।

Advertisement

সৌমেন দত্ত ও সুচন্দ্রা দে

কাটোয়া শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৮ ০০:৩২
Share:

ফাঁকা: প্রস্তুতি ছিল, কিন্তু দেওয়াল ফাঁকাই। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়

বিধানসভা হোক বা পঞ্চায়েত, ভোর হলেই ভোট দিতে ছুটতেন কেতুগ্রামের ব্যবসায়ী সুরেন্দ্রনাথ দে। লাইনে দাঁড়ানো, আঙুলে কালি, যাওয়া-আসার পথে টুকটাক গল্পগাছা, আবার কখনও ভয় দেখানো, হুমকি— সবেই দিনটা অন্যরকম মনে হতো তাঁর। কিন্তু এ বার ভোটের দিন সেই দোকানে কাটবে ভাবলেই মনখারাপ হয়ে যাচ্ছে তাঁর।

Advertisement

এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে কাটোয়া মহকুমার পাঁচ ব্লকের ৬৩৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ১৩৪টি পঞ্চায়েত সমিতি ও ১১টি জেলা পরিষদের আসনই বিরোধীশূন্য। আদালতের রায় মেনে ৩ জুলাই শুনানি না হওয়া পর্যন্ত এ সব আসনের ভাগ্য মুলতুবি। স্বাভাবিক ভাবেই ভোটের চেনা মেজাজ হাওয়া। একাধিক গ্রামের দেওয়াল চুনকাম হয়ে পড়ে রয়েছে। কোথাও তৃণমূল প্রার্থীর নাম জয়ী বলে লিখেও রঙের পোঁচ দিয়ে তা ঢেকে দেওয়া হয়েছে। শাসকদলের নেতারাই বলছেন, ‘‘পরীক্ষাই নেই তো প্রস্তুতি!’’

কিন্তু ২০১৬-র বিধানসভা ভোটেও যেখানে কংগ্রেস-সিপিএমের প্রার্থী শ্যামা মজুমদারের চেয়ে মাত্র ৯১১ ভোটে এগিয়ে তৃণমূলের বিধায়ক হন রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। দাঁইহাট পুরসভা, কাটোয়া ১ পঞ্চায়েত সমিতি-সহ একাধিক পঞ্চায়েত সিপিএমের হাতে ছিল, সেখানে কোন জাদুতে বিরোধীরা ঘেঁষতেই পারলেন না, সে প্রশ্নও উঠছে। কাটোয়ার রেলগেট এলাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, “কয়েকদিন আগেই সিপিএমের এক নেতার নেতৃত্বে কাটোয়া ১ ব্লক দফতরে যাচ্ছিল সিপিএম। রেলগেট পড়তেই তিনশো জনের মিছিল গিয়ে দাঁড়ায় ৭০ জনে! তারাও বিক্ষিপ্ত হয়ে যেতেই প্রকাশ্যেই হতাশা জানান ওই নেতা।” রাশ আলগা হওয়ার কথা মেনে সিপিএমের এক নেতা বলেন, “বিধানসভা নির্বাচনের ফল রবীন্দ্রনাথবাবুর বিরুদ্ধে গিয়েছিল বলা যায়। সেই সময় থেকে সংগঠনের হাল ধরা উচিত ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি বলেই কাটোয়াতে আমরা দাঁড়াতেই পারলাম না।” আরেক নেতার কথায়, “কতটা পথ এগোলে কর্মীরা বিজেপিতে যাবে না—এই চিন্তা করতে গিয়েই আমরা আরও নড়বড়ে হয়ে গিয়েছি।” যদিও প্রকাশ্যে সন্ত্রাস, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে আতঙ্ক ছড়ানোকেই প্রার্থী দিতে না পারার কারণ হিসেবে দাবি করছেন তাঁরা।

Advertisement

সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য অঞ্জন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “প্রকাশ্যেই আমাদের নেতা তপন কোনার-সহ কয়েকজনের উপর হামলা হয়েছে। রাস্তায় বোমা-বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হুমকি দেওয়াটা কী যথেষ্ট নয়।” বিজেপির বর্ধমান গ্রামীণের সাংগঠনিক সভাপতি কৃষ্ণ ঘোষও বলেন, “বোমা-গুলি মেরে আমাদের পথ আটকানো হয়েছে।” যদিও বিধায়ক রবিবাবু বলেন, প্রতিটি দফতরই তো ফাঁকা ছিল। বিরোধীরা গেলেন না কেন, বুঝতে পারছি না।” তবে নেতারা যাই বলুন এমন নিরুত্তাপ ভোট মেনে নিতে পারছেন না কোনও দলের নেতা-কর্মীরাই।

অন্য সময় পঞ্চায়েত ভোটের আগে ব্যালট ছাপানোর হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। এ বার কাজের বরাত পাননি ছাপাখানার মালিকেরাও। কাটোয়ার বাণী প্রেসের কর্নধার নিমাই দত্ত বলেন, ‘‘ব্যালট ছাপার প্রস্তুতি ছিল। ভোট না হওয়ায় বাজার মন্দা গেল।’’

আক্ষেপের সুর নতুন ভোটারদেরও কথাতেও। কলেজ পড়ুয়া তনুশ্রী দত্ত, পলি হাজরাদের কথায়, ‘‘এত দিন বাবা-মা, বাড়ির বড়দের ভোট দিতে যেতে দেখেছি। এ বা প্রথম ভোট দেব ভেবে উৎসাহী ছিলাম। সবই জলে গেল।’’

বিল্লেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নির্মাল্য চট্টোপাধ্যায়ের মনে পড়ে যায় অন্য বার ভোট দেওয়ার পরে চায়ের দোকানের দানের আড্ডা। কোন বুথে, কোন দল এগিয়ে থাকবে, কোথায় গোলমাল, মারামারি হবে সে নিয়ে জোর চর্চা চলত। এ বার সব ফিকে। কাটোয়া কলেজের শিক্ষক তপোময় ঘোষ বলেন, ‘‘দেওয়াল লিখন থেকেই প্রস্তুতি চলত। এ সময় বোরো ধান কাটা হয় বলে দিনে শ্রমিকদের পাওয়া যেত না। তাই সন্ধ্যা হলেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার চালাতেন স্থানীয় নেতৃত্ব। সবই ফাঁকা লাগছে।’’ নবদ্বীপধাম বিদ্যাপীঠের শিক্ষক গোপাল চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘ভোটের দিন শিবির করে ছোলা, মুড়ি চালাচালি হতো। এ বার গোটা মহকুমা ভোটে ব্রাত্য ভাবতেই পারছি না।’’ ওই স্কুলের আর এক শিক্ষক মহাদেব হাজরাও বলেন, ‘‘এমন পরিবেশ কাটোয়া আগে দেখেনি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement