দাউ দাউ: খাদানের নানা এলাকায় এ ভাবেই আগুন ধরানো হয়েছে। বুধবার দামোদরের পাড়ে। ছবি: কাজল মির্জা
ক’দিন আগেই বলেছিলেন, ‘পালিয়ে যা, পালিয়ে যা...’।— ‘পালানো’ হয়নি সুচিত্রা মালিক (৫৫) আর তাঁর পরিবারের। বালির ট্রাকের তলায় চাপা পড়া সুচিত্রা এবং চার জনের দেহগুলি ততক্ষণে উদ্ধার করা হয়েছে। আর সুচিত্রাদেবীর মেয়ে দোলন মণ্ডলের (৩০) দেহের দিকে তাকিয়ে ক’দিন আগের সেই পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ বা আক্ষেপের কথাটাই বুধবার বলে চলেছিলেন গ্রামের মেয়ে নমিতা মাঝি। এমন আক্ষেপের পাশাপাশি, গলসির শিকারপুর বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া এলাকায় (রসিকপুর) রয়েছে বাসিন্দাদের ক্রোধ, দ্বন্দ্বও।
নমিতা বলছিলেন, ‘‘কয়েক দিন আগেই নন্দিনীর মা দোলনকে বলেছিলাম, বাঁধের গা থেকে পালিয়ে অন্য কোথাও উঠে যা। না হলে ট্রাকে চাপা পড়ে মরবি। সেটাই হল।’’
বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেল, একটা পরিবারের ‘না-পালানোর’ চিহ্ন। ওই পাঁচ জন যে বাড়িতে থাকতেন, সেটির অর্ধেক ট্রাকে বাকি অর্ধেক জায়গা বালিতে চাপা পড়ে গিয়েছে। এক চিলতে ফাঁকা জায়গায় শোয়ানো আড়াই বছরের আবির মণ্ডল, তার দিদি স্থানীয় স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী নন্দিনীর (৯) দেহ। পাশেই শোয়ানো তাদের বাবা, পাশের গ্রাম বন্দুটিয়ার বাসিন্দা বাপি মণ্ডল (৩৪), মা দোলনের দেহ। তার পাশেই দিদা সুচিত্রার দেহ। বালির তলায় চাপা পড়ে নন্দিনীর স্কুল-ব্যাগ। পাশেই রয়েছে, সাদা রঙের একটা খেলনা গাড়ি। কিছু দূরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে স্টিলের মগ, শিল, বালির তলায় লেপ, কাঁথা, কাঁসার বাসন— ভেঙে যাওয়া গেরস্থালির চিহ্ন। আর অদূরে বালিতে গাঁথা কোদাল-বেলচা। তা দিয়েই দেহগুলি উদ্ধার করেন এলাকাবাসী।
ওঁরা যে এলাকার বাসিন্দা ছিলেন, অর্থাৎ সেই মেরেকেটে ছ’ফুট চওড়া বাঁধটির দু’ধারেই রয়েছে বসতবাড়ি। বাড়িগুলি বৈধ কি না, প্রশ্ন উঠতেই ঝাঁঝিয়ে ওঠেন বাসিন্দারা। বলেন, ‘‘তিন, সাড়ে তিন দশকের ভিটে আমাদের। বাঁধের গায়ে সরকারি প্রকল্পের বাড়িও রয়েছে। বালি খাদানগুলি তো হয়েছে দু’বছর।’’
আলোহীন ওই বাঁধ দিয়ে, শিকারপুর থেকে গলসি পর্যন্ত গ্রামের ভিতর দিয়ে যাওয়া ১৩ কিলোমিটার রাস্তা দিয়ে ছোটে বালির অজস্র ট্রাক। কেঁপে ওঠে বাড়ি। বালির ট্রাক যাওয়ার জন্য রাস্তাও বেহাল, অভিযোগ এলাকাবাসীর। ওই রাস্তা সংস্কারের জন্য পুলিশও নানা জায়গায় চিঠি দিয়েছে। এ দিন এলাকায় দাবি ওঠে, খাদান বন্ধ হোক। জেলা প্রশাসনও সেই আশ্বাসই দিয়েছে।
অদূরেই দামোদর, ‘বালির পাহাড়’, বালি কাটার যন্ত্র। অতিরিক্ত বালিবোঝাই ট্রাক চলাচলের অভিযোগে কিছু দিন আগে এলাকায় বিক্ষোভ, ছোটখাটো দুর্ঘটনাও ঘটেছে। কয়েক জন গ্রামবাসী বলেন, ‘‘এলাকার কেউ কাজ পায় না। অথচ, খাদানের জন্য প্রাণ যাচ্ছে আমাদের।’’
ওই বৈধ খাদান আর তার ট্রাকগুলির জন্য রাস্তায় দাঁড়ালেই চাপা পড়ার ভয়, ছেলেমেয়েদের মিঠাপুর উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে যাওয়ার ভয় রয়েছে। তবুও সেই ভয় আর পাঁচ জন পড়শিকে হারানোর যন্ত্রণা নিয়েই কয়েকজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাসিন্দা এ-ও বলেন, ‘‘খাদান বন্ধ হলে খাব কী? খাদানগুলো আছে বলে অনেকেরই সংসার চলে। বরং খাদানে যাওয়ার জন্য বিকল্প রাস্তা তৈরি করা হোক।’’
কিন্তু সে রাস্তা কোন দিক দিয়ে হবে? নিরুত্তর ওই বাসিন্দারা। জেলাশাসক (পূর্ব বর্ধমান) বিজয় ভারতী বলেন, ‘‘এ দিনের দুর্ঘটনায় মৃতদের পরিবার যাতে ক্ষতিপূরণ পায়, সে চেষ্টা করা হচ্ছে।’’ তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথও বলেন, ‘‘পুরো বিষয়টি প্রশাসন দেখছে।’’
এই ঘটনা নিয়ে বিজেপি-তৃণমূল চাপানউতোরও তৈরি হয়েছে। বিজেপি নেতৃত্ব জানান, তাঁরা ঘটনাস্থলের কাছেই বাঁধের উপরে অবস্থান করছিলেন। পরে প্রশাসন লিখিত আশ্বাস দিলে তাঁরা উঠে যান। কিন্তু শিকারপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে তাঁদের এক নেতা আশ্বাসের কথা ‘স্ট্যাম্প পেপারে’ লিখে দেওয়ার জন্য বললে তাঁকে তৃণমূলের লোকজন নিগ্রহ করে বলে অভিযোগ বিজেপির জেলা সভাপতি (বর্ধমান সদর) সন্দীপ নন্দীর। তাঁর আরও অভিযোগ, ‘‘সবেই অনিয়ম। সে জন্যই এত জনের প্রাণহানি।’’ তবে তৃণমূলের গলসি ২ ব্লক সভাপতি বাসুদেব চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘নিগ্রহের ঘটনায় দল যুক্ত নয়। বিজেপি অশান্তির চেষ্টা করছিল বলে এলাকাবাসী ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন।’’ বিজেপি কিছুক্ষণ পানাগড়ে জাতীয় সড়কও অবরোধ করে।