পড়ে রয়েছে দুমড়ে যাওয়া দুধের গাড়িটি। —উদিত সিংহ।
অনেকক্ষণ থেকেই একটানা হর্ন দিচ্ছিল মোটরবাইকটি। তবে রাস্তাটা ততটা চওড়া না হওয়ায় জায়গা ছাড়া যাচ্ছিল না। হঠাৎ ইট-পাথর ছুড়তে শুরু করে মোটরবাইকে থাকা তিন যুবক। বেসামাল হয়ে সটান রাস্তার পাশে দাঁড়ানো ট্রাকে ধাক্কা মারে গাড়িটি— হাসপাতালে শুয়ে ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিলেন মাঝবয়েসী চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়। তিন সঙ্গীকে এক লহমায় হারিয়ে ফেলার ধাক্কা তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি।
বৃহস্পতিবার রাত ১১টা নাগাদ বর্ধমানের তিনকোনিয়া এলাকায় জিটি রোডের উপর ওই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন তিন জন। প্রতিদিনের মতোই গাড়ি নিয়ে দুধ আনতে যাচ্ছিলেন তাঁরা। বরাতজোরে বেঁচে গিয়েছেন চিন্ময়বাবু। এলাকার বাসিন্দারাও মোটরবাইকের দাপাদাপি, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার আশঙ্কার অভিযোগ করেছেন। পুলিশ অবশ্য শুক্রবার রাত পর্যন্ত ওই মোটরবাইক বা তিন আরোহীর কারও সন্ধান পায়নি। পুলিশ জানিয়েছে, মৃত তিন জনের এক জন অচিন্ত্য দত্ত (৫০)। তাঁর বাড়ি মুর্শিদাবাদের সালার থানার বদ্যিপুর। আরেক জন রবিন ঘোষ (৩৬) কাটোয়ার গোয়াল পাড়ার বাসিন্দা। আর শ্যামসুন্দর পাখিরার (৩৫) বাড়ি হুগলির পুরশুড়ায়।
শুক্রবার বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি চিন্ময়বাবু জানান, তাঁরা চার জনেই হাওড়ার মুন্সির হাট এলাকার একটি দুগ্ধ উৎপাদন কারখানার কর্মী। প্রায় প্রতিদিনই এ রাস্তা দিয়ে কাটোয়া গোয়ালপাড়ায় দুধ নিতে যেতেন তাঁরা। বৃহস্পতিবারও সন্ধ্যা নাগাদ বেরিয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে তেলিপুকুর দিয়ে বর্ধমান শহরে ঢোকেন। তেলিপুকুর মোড় থেকেই একটি মোটরবাইক গাড়টির পিছু নেয় বলে তাঁর দাবি। বাইক আরোহীরা রাস্তা ছাড়ার জন্য বারবার হর্ন দিচ্ছিল। গতিও ছিল বেপরোয়া। কিন্তু রাস্তা তেমন চওড়া না হওয়ায় দুধের গাড়িটির চালক শ্যামসুন্দরবাবু সরতে পারছিলেন না বলে চিন্ময়বাবুর দাবি। তাঁর অভিযোগ, আচমকা গাড়ি লক্ষ করে ইট-পাথর ছুড়তে থাকে মোটরবাইক আরোহীরা। চলে গালিগালাজ। তিন জনেই মদ্যপ অবস্থায় ছিল বলেও তাঁর দাবি।
চিন্ময়বাবু জানান, জিটি রোডে পড়ার পরে ওদের কিছুক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়নি। কিন্তু তিনকোনিয়ার কাছাকাছি আসতেই আবারও হঠাৎ ভেসে উঠে ওই তিন জন গাড়িতে ইট- পাথর ছুড়তে থাকে বলে অভিযোগ। ইটের ঘায়ে আহত হন শ্যামসুন্দরবাবু। মুখে-মাথায় আঘাত লাগে তাঁর। বেসামাল হয়ে যায় গাড়িটি। এরপরেই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালবাহী ট্রাকের পিছনে গাড়িটি ধাক্কা মারে। চিন্ময়বাবু বলে, ‘‘আর কিছু মনে নেই। তখনই জ্ঞান হারাই আমি।’’
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রাতের দিকে তিনকোনিয়ার কিছু হোটেল, দোকান বেশির ভাগ এলাকায় ফাঁকা হয়ে যায়। যে দু’এক ছিলেন তাঁদের মধ্যে স্থানীয় বাসিন্দা বাচ্চু রায় বলেন, ‘‘একটি বড় ভ্যান প্রচণ্ড গতিতে আসছিল। হঠাৎই সেটি রাস্তার ধারে দাঁড়ানো ট্রাকের পিছনে ঢুকে যায়। তবে এমন এলোপাথাড়ি ভাবে আসছিল মনে হচ্ছিল কিছু একটা হয়েছে। গিয়ে দেখি রক্তারক্তি কান্ড।’’ আর এক প্রত্যক্ষদর্শী গাড়ি চালক বাবু ঘোষ জানান, তিনকোনিয়ার কাছে জিটি রোডের ধারে একটা মোটরবাইককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন তিনি। হঠাৎই সেটি কার্জন গেটের দিকে চলে যায়। তারপরেই গাড়িটি এসে ধাক্কা মারে বলেও তাঁর দাবি।
ঘটনায় থম মেরে গিয়েছেন তিন বাড়ির লোকজন। বর্ধমান মেডিক্যালে আসা শ্যামসুন্দরবাবুর এক আত্মীয় বিজয় পাখিবা বলেন, ‘‘রোজই গাড়ি নিয়ে দুধ আনতে যেত ওরা। মোটরবাইক নিয়ে এসে পাথর ছুঁড়ে এমন কাণ্ড করে ফেলল ভাবতেই পারছি না।’’ তাঁর দাবি, ‘‘সমাজবিরোধীদের দাপাদাপি কমাতে পুলিশের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’’ অচিন্ত্যবাবুর এক ভাইপো অখিলও বলেন, ‘‘রাতে বর্ধমান শহরের আইনশৃঙ্খলা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে বোঝা যাচ্ছে। বেঘোরে প্রাণ গেল তিন জনের।’’ সন্ধ্যার পর থেকে শহরে মোটরবাইকের দাপাদাপি, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো যে বেড়েই চলেছে তা বলছেন বাসিন্দাদের একাংশও। তিনকোনিয়া গুডশেড রোডের বাসিন্দা সুজন সিংহের দাবি, ‘‘পুলিশ-প্রশাসন হাল না ধরলে খুব মুশকিল।’’ পার্কার্স রোডের বাসিন্দা কলেজ ছাত্র হাসমত আলি বলেন,‘‘টিউশন সেরে, বাজার করে সাইকেল চড়ে ফিরি। যে কোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
বর্ধমান থানার এক এসআইও মোটরবাইকের বেলাগাম গতি মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘শহর তো বটেই শহর লাগোয়া দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতেও মোটরবাইকের দাপাদাপি বেড়েছে। মাঝেমধ্যেই অভিযান চালানো হয়। তবে সবটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।’’ বর্ধমান থানা সূত্রে জানা গিয়েছে, এই ঘটনায় থানায় কোনও লিখিত অভিযোগ হয়নি, তবে আহতের বয়ান অনুয়াযী তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। ওই মোটরবাইক ও তিন যুবকের খোঁজও চলছে।