সিকন্দরের মতোই উড়ান শেষ বুলেটে

হিন্দি ছবির চিত্রনাট্যের মতোই জীবন ছিল তার। শেষটাও হল সিনেমার মতো। বলছেন বাবু সেন ওরফে তারক ঘোষের প্রতিবেশীরা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মধ্যমগ্রামে দুষ্কৃতীদের গুলি ঝাঁঝরা করে দিয়েছে যাকে। খাতায়-কলমে জমি-বাড়ির দালাল ও প্রোমোটার। কিন্তু এটুকু বললে বাবু সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। ‘‘অনেকটা মুকদ্দর কা সিকন্দরের অমিতাভ’’— বলছিলেন এক প্রতিবেশী। কৈশোরে অনাথ। খানিকটা কপালজোর, খানিকটা নিজের ক্ষমতায় প্রচুর টাকার মালিক হয়ে ওঠা। সেই সঙ্গে শত্রুর সংখ্যাটাও বাড়তে থাকা। শত্রুদের মোকাবিলা করতে বাবু সব সময়ে সঙ্গে রাখত আগ্নেয়াস্ত্র। মৃত্যুর পরেও কোমরে গোঁজা ছিল ইম্প্রোভাইজড পিস্তল। শুধু চালানোর ফুরসত মেলেনি।

Advertisement

বিতান ভট্টাচার্য ও শান্তনু ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৫ ০৩:২৩
Share:

বাবু সেন।—ফাইল চিত্র।

হিন্দি ছবির চিত্রনাট্যের মতোই জীবন ছিল তার। শেষটাও হল সিনেমার মতো। বলছেন বাবু সেন ওরফে তারক ঘোষের প্রতিবেশীরা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মধ্যমগ্রামে দুষ্কৃতীদের গুলি ঝাঁঝরা করে দিয়েছে যাকে।

Advertisement

খাতায়-কলমে জমি-বাড়ির দালাল ও প্রোমোটার। কিন্তু এটুকু বললে বাবু সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। ‘‘অনেকটা মুকদ্দর কা সিকন্দরের অমিতাভ’’— বলছিলেন এক প্রতিবেশী। কৈশোরে অনাথ। খানিকটা কপালজোর, খানিকটা নিজের ক্ষমতায় প্রচুর টাকার মালিক হয়ে ওঠা। সেই সঙ্গে শত্রুর সংখ্যাটাও বাড়তে থাকা। শত্রুদের মোকাবিলা করতে বাবু সব সময়ে সঙ্গে রাখত আগ্নেয়াস্ত্র। মৃত্যুর পরেও কোমরে গোঁজা ছিল ইম্প্রোভাইজড পিস্তল। শুধু চালানোর ফুরসত মেলেনি।

বাবা-মা তার মারা গিয়েছিলেন ছোটবেলাতেই। হাওড়ায় কাকার বাড়িতে থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা। এর পর বেলঘরিয়ায় কিশোরপল্লিতে দিদির বাড়িতে চলে আসা। জামাইবাবু প্রদীপ সেন স্থানীয় চাটনি কারখানার কাজে ঢুকিয়ে দেন বাবুকে। এই সময় থেকেই জামাইবাবুর ‘সেন’ পদবি ব্যবহার করতে থাকে বাবু। কারখানাটা এক দিন বন্ধ হয়ে যায়। বাবু তখন ঢোকে প্লাস্টিকের জিনিসপত্র তৈরির কারখানায়।

Advertisement

কিন্তু মন টেকেনি। বেলঘরিয়া এলাকার পুরোনো বাসিন্দারা জানান, কারখানায় কাজ করতে করতেই জমির দালালদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেই ব্যবসাতেও নেমে পড়ে বাবু। কম দামে জমি কিনে বেশি দামে তা বিক্রি করাই ছিল ব্যবসা। এক সময় কারখানার কাজ ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর দালালিই শুরু করে বাবু। তৈরি করে নিজের ‘গ্যাং’। সেই দলেরই অন্যতম সদস্য ছিল আগরপাড়ার ডাকাবুকো নুঙ্কাই ওরফে নিতাই পাল। মাছের ব্যবসা ছেড়ে সে বাবুর ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠে। বৃহস্পতিবার বাবুর সঙ্গেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় নুঙ্কাই।

নিজের ‘গ্যাং’ তৈরি করে বেলঘরিয়া, আগরপাড়া, মধ্যমগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় কারখানার বাতিল লোহালক্কড় কেনাবেচা, পুরনো বাড়ি ভাঙা, পুকুর ভরাটের কাজ শুরু করে বাবু। ক্রমশ ওই সব এলাকার প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে দহরম-মহরম শুরু হয় তার। বাবু তখন সিপিএম নেতার বেশ কয়েক জনের ‘স্নেহধন্য’ ছিল বলে অভিযোগ।

আশির দশকের মাঝামাঝি বেআইনি অস্ত্র সরবরাহের ব্যবসা শুরু করে বাবু। পুলিশ জানিয়েছে, প্রথমে মুঙ্গের থেকে আগ্নেয়াস্ত্র কিনে রাজ্যের দুষ্কৃতীদের কাছে বিক্রি করত বাবু। এর পরে সে ঠিক করে, নিজেই খুলবে অস্ত্র কারখানা। মুঙ্গের থেকে অস্ত্র তৈরি শিখে মধ্যমগ্রামের বাদুতে বাবু তৈরি করে সেই কারখানা। জলের মতো টাকা আসতে থাকে হাতে। ২০১০ সালে বেলঘরিয়ার ডেরা পাল্টে বাবু চলে যায় আগরপাড়ায়। এই বেআইনি অস্ত্র কারখানার সূত্রেই এই সময়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে বাবু। কিছু দিনের মধ্যে জামিনে ছাড়াও পায়।

ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের বেলঘরিয়া, নিমতা, খড়দহ এবং ঘোলা থানা এলাকায় কখনও জমি-বাড়ি দখল, কখনও গুন্ডাগিরি— অভিযোগ লেগেই থাকত বাবুর বিরুদ্ধে। ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের এক কর্তার কথায়, ‘‘গুনে বলা মুশকিল, গত তিরিশ বছরে বাবুর নামে কতগুলো এফআইআর আছে।’’ তিনি জানালেন, গ্রেফতার হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই আইনজীবী জোগাড় করে ঠিক বেরিয়ে যেত বাবু। বাবুর আইনি পরামর্শদাতা ছিলেন বারাসতের এক আইনজীবী। খুন হওয়ার আগের দিনও তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিল বাবু।

পুলিশ সূত্রের খবর, গত বছর শিশু উদ্যান তৈরির নাম করে পানিহাটিতে একটি জলা ভরাটের কাজে নেমেছিল বাবুর দলবল। এই কাজ করতে গিয়েই বখরা নিয়ে গোলমাল হয় পার্থসারথি সেনগুপ্ত ও সুরজিৎ দাস নামে দুই যুবকের সঙ্গে। ২০১৪-র ২৬ জানুয়ারি ওই দুই যুবককে বাড়ি থেকে তুলে আগরপাড়ার গাঙ্গুলিবাগানে খুন করা হয়। এই খুনের অভিযোগে পুলিশ বাবুকে গ্রেফতার করেছিল। মাস তিনেক আগে সে জামিনে ছাড়া পায়। এ ছাড়া এয়ারপোর্ট এলাকার একজনের দিকে গুলি চালানোর অভিযোগও বাবুর বিরুদ্ধে ছিল বলে পুলিশের দাবি। নিমতার ফতুল্লাপুরেও একটি খুনের ঘটনাতেও সে ছিল অভিযুক্ত। বেলঘরিয়া, মধ্যমগ্রাম, আগরপাড়ায় বাড়ি রয়েছে বাবুর। কোথাও বেশিদিন থাকত না সে। সম্প্রতি বেলঘরিয়ার মিলনপল্লিতেও জমি কিনেছিল।

রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পরেই বাবু ‘ঘর’ পাল্টায়। একদা সিপিএমের স্নেহধন্য বাবু হয়ে ওঠে তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ। সদ্য মিটে যাওয়া পুরভোটে উত্তর দমদম এলাকার দুটি ওয়ার্ডে ভোট পরিচালনার দায়িত্বে্ ছিল বাবু ও তার দলবল। বাবুর দিদি বাণী সেনও বললেন, ‘‘প্রথমে সিপিএম করলেও পরে ব্যবসাটা ভাল করে করবে বলেই ভাই তৃণমূলের সঙ্গে মিশতে শুরু করেছিল। ও বলত— এখন সিপিএম নেই। তাই তৃণমূলের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখতে হবে।’’

এমন চুলচেরা হিসেবেও গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল কোথাও। তাই পর্দার সিকন্দরের মতোই অকালে দাঁড়ি পড়ে গেল বাবু সেনের জীবনেও!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement