মন্ত্রী-মেয়রের কিস্‌সা

ফিশফ্রাই ইতিহাস, অশোক ফিরলেন খালি হাতে

ফিশফ্রাই অতীত! ঝালমুড়িও ইতিহাস। তৃণমূল আবার ফিরছে সেই বয়কটের রাজনীতিতেই! কলকাতায় এসে রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম এবং জনস্বাস্থ্য কারিগরি মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে খালি হাতেই ফিরতে হল শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্যকে। মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন বলে অশোকবাবু যখন বুধবার দুপুরে মহাকরণের করিডরে অপেক্ষা করছেন, দুই মন্ত্রীই তখন বিধানসভায়। শিলিগুড়ির মেয়র দেখা করতে আসছেন জেনেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের মন্ত্রীরা তাঁকে এড়িয়ে গিয়েছেন বলেই সিপিএমের অভিযোগ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৫ ০৩:৫৬
Share:

অপেক্ষাই সার। দুই মন্ত্রীর দেখা না-পেয়ে বুধবার মহাকরণ ছাড়লেন শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্য।—নিজস্ব চিত্র।

ফিশফ্রাই অতীত! ঝালমুড়িও ইতিহাস। তৃণমূল আবার ফিরছে সেই বয়কটের রাজনীতিতেই!

Advertisement

কলকাতায় এসে রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম এবং জনস্বাস্থ্য কারিগরি মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে খালি হাতেই ফিরতে হল শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্যকে। মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন বলে অশোকবাবু যখন বুধবার দুপুরে মহাকরণের করিডরে অপেক্ষা করছেন, দুই মন্ত্রীই তখন বিধানসভায়। শিলিগুড়ির মেয়র দেখা করতে আসছেন জেনেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের মন্ত্রীরা তাঁকে এড়িয়ে গিয়েছেন বলেই সিপিএমের অভিযোগ। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের মন্তব্য, ‘‘আমরা সরকারে থাকার সময়ে বিরোধী হিসাবে ওঁদের আমন্ত্রণ করলেও তৃণমূল নেতারা বয়কট করতেন। এখন ওঁরা সরকারে আছেন। আমাদের দলের প্রতীকে নির্বাচিত মেয়র চিঠি দিয়ে সাক্ষাতের সময় নিয়ে দেখা করতে গেলেও ওঁরা সেই বয়কটই করছেন!’’

রাজ্য সরকার বা দল হিসাবে তৃণমূল বয়কটের অভিযোগ খারিজ করলেও সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের কটাক্ষ, ‘‘মন্ত্রীরা অশোকবাবুর সঙ্গে দেখা করতে ভয় পেয়েছেন! যদি ওঁদের চাকরি না থাকে!’’ আর মহাকরণে পুরমন্ত্রীর ঘরের বাইরে বসে থাকতে হওয়ায় দুঃখিত হলেও সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক সেরে অশোকবাবু অবশ্য রাতে শিলিগুড়ির ট্রেন ধরতে যাওয়ার পথে বলে গিয়েছেন, ‘‘এর পরেও সংঘাতের পথে যেতে চাই না। সাংবিধানিক দায়িত্ব মেনে শিলিগুড়ির মানুষের জন্য আবার দেখা করতে আসব!’’

Advertisement

অশোকবাবু দীর্ঘ দিন রাজ্যের পুরমন্ত্রী ছিলেন। আর সুব্রতবাবু, ফিরহাদেরা কলকাতা পুরসভায় তৃণমূলের পুরবোর্ডে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। দু’তরফের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও মন্ত্রী হিসাবে অশোকবাবু মেয়র সুব্রতবাবুদের কখনও দেখা না করে ফিরিয়ে দিয়েছেন, এমন অভিযোগ ওঠেনি। অথচ এ দিনের ঘটনায় শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘অসৌজন্যে’র অভিযোগই উঠেছে। অশোকবাবুর কথায়, ‘‘আমি মন্ত্রী থাকার সময়ে মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায় দেখা করতে এলে পাশের চেয়ারে বসিয়েছি। ববিও যখন চেয়েছে, সাহায্য করেছি। আজ আমি একটা শহরের মেয়র হিসাবে দেখা করতে এসে মন্ত্রীর ঘরের বাইরে বসে থাকলাম! আমাকে নয়, অপমান করা হল শিলিগুড়ির মানুষকে।’’

যদিও সুব্রতবাবু ও ফিরহাদ বয়কট বা অসৌজন্যের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের দাবি, তাঁরা যে বিধানসভায় থাকবেন, অশোকবাবুকে তা জানানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি বিধানসভায় না গিয়ে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন! সুব্রতবাবু যেমন বলেছেন, ‘‘মঙ্গল ও বুধবার অশোকবাবু ফোন করেছিলেন। পুরসভার ব্যাপারে আমার তো কিছু করার নেই। তবু আমি বলেছিলাম, বিধানসভায় দেখা করতে। কিন্তু উনি সেখানে আসেননি।’’ আর ফিরহাদের মন্তব্য, ‘‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অনেকেই অনেক কথা বলেন। অশোকবাবু আমাকে চিঠি দিয়ে দেখা করতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, বিধানসভা চলছে। এখন এলে বিধানসভায় আসতে হবে। নয়তো ১৮ জুনের পরে দেখা করব। কিন্তু উনি বিধানসভায় আসবেন না!’’ বিধানসভায় নিজের ঘরেই এ দিন দিনহাটা পুরসভার নতুন চেয়ারম্যান তথা ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক উদয়ন গুহের সঙ্গে দেখা করেছেন ফিরহাদ। তাঁর প্রশ্ন, তা হলে আর বামেদের বয়কটের প্রশ্ন আসছে কেন? তাঁর আরও দাবি, চন্দননগরে তৃণমূল পরিচালিত পুরসভার মেয়র রাম চট্টোপাধ্যায়ও পুরমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গেও সাক্ষাৎ হবে অধিবেশন মিটে গেলে।

“কুড়ি বছরের বেশি মন্ত্রী ছিলাম। মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায় দেখা করতে এলে মন্ত্রীর ঘরে, পাশের চেয়ারে বসিয়েছি। ববিও যখন চেয়েছেন, সাহায্য করেছি। আজ আমি একটা শহরের মেয়র হিসেবে দেখা করতে এসে মন্ত্রীর ঘরের বাইরে বসে থাকলাম! আমাকে নয়, অপমান করা হল শিলিগুড়ির মানুষকে।”

অশোক ভট্টাচার্য

“কাল ও আজ (মঙ্গল ও বুধবার) অশোকবাবু ফোন করেছিলেন।
পুরসভার ব্যাপারে আমার তো কিছু করার নেই। তবু বলেছিলাম, বিধানসভায় দেখা করতে। কিন্তু উনি সেখানে আসেননি।”

সুব্রত মুখোপাধ্যায়

“রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অনেকেই অনেক কথা বলেন।
অশোকবাবু আমাকে চিঠি দিয়ে দেখা করতে চেয়েছিলেন।
আমি বলেছিলাম, বিধানসভা চলছে। এখন এলে বিধানসভায় আসতে হবে। নয়তো ১৮ জুনের পরে দেখা করব। কিন্তু উনি বিধানসভায় আসবেন না।”

ফিরহাদ হাকিম

দুই মন্ত্রী এমন দাবি করলেও প্রশ্ন থাকছে, নিজে দীর্ঘ মন্ত্রিত্বের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অশোকবাবু সাক্ষাতের কোনও আশ্বাস ছাড়াই মহাকরণে পৌঁছে যাবেন, এ কথা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? এই সূত্রেই উঠে আসছে বয়কটের তত্ত্ব। লোকসভা ভোটের সময় রাজ্যে যখন বিজেপির উত্থান ঘটছে, সেই সময়ে নবান্নে বিমান বসু-সহ বাম নেতাদের সাক্ষাতের সময় দিয়ে ফিশফ্রাই সহযোগে তাঁদের আপ্যায়ন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। বিমানবাবুদের তিনি ‘দল সামলানো’র পরামর্শও দিয়েছিলেন! সেই সময়বিজেপি-কে প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করায় এ রাজ্য থেকে নির্বাচিত সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাননি রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ। বাবুলকে তখন ‘হাফমন্ত্রী’ বলে কটাক্ষ করতেন সুব্রতবাবুরা! এখন আবার পুরভোটের পরে রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টে গিয়েছে। বিজেপি ধাক্কা খাওয়ায় তৃণমূলের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে ফিরে এসেছে বামেরাই। যে কারণে মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভার ভিতরে-বাইরে বামেদেরই নিশানা করছেন। তার জের টেনে অশোকবাবুকে মন্ত্রীদের দেখা না পেয়ে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। আর, মুখ্যমন্ত্রীর গাড়িতে সওয়ার হয়ে ঝালমুড়ি-ভেলপুরি খেয়ে দলেই সমালোচিত হচ্ছেন বাবুল!

রাজ্যের মন্ত্রীদের কাছে ‘বয়কটে’র শিকার হয়ে অশোকবাবু এ দিন বলেছেন, ‘‘এমন পাঠশালায় আমি পড়িনি! ব্যক্তিগত কোনও স্বার্থে তো দেখা করতে যাইনি। গিয়েছিলাম শিলিগুড়ির মানুষের প্রতিনিধি হয়ে।’’ সুব্রতবাবুর দাবি খণ্ডন করেই তাঁর পাল্টা দাবি, পানীয় জলের বিষয়েই বিভাগীয় মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার ছিল। মন্ত্রী তাঁকে বলেছিলেন ২৭ তারিখ তিনি ‘খালি’ থাকবেন। অথচ এ দিন বলা হয়, সুব্রতবাবু বাজেটের জন্য বিধানসভায় ব্যস্ত। যদিও, সুব্রতবাবুর পঞ্চায়েত দফতরের বাজেট নির্ধারিত আছে শুক্রবার! আর ফিরহাদও তাঁকে বিধানসভায় যাওয়ার কথা বলেননি বলে অশোকবাবুর দাবি।

বস্তুত, অশোকবাবুর অভিযোগ, শিলিগুড়িতে তাঁরা বোর্ড গ়ড়ার প্রক্রিয়া শুরু করার পর থেকেই রাজ্য সরকারের তরফে অসৌজন্য দেখানো হচ্ছে। মহাকরণে এ দিন পুরমন্ত্রীর ঘরের বাইরে ১০ মিনিট বসে থাকার পরে পুরসচিবের কাছে তিনি জানতেও চেয়েছেন, একটি শহরের মেয়রের প্রতি এই কি সৌজন্য? যদিও পুর দফতর সূত্রে বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ের আগেই অশোকবাবু মহাকরণে পৌঁছে যাওয়ায় তাঁকে অল্পক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তার পরেই পুরসচিব তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। যে বক্তব্য থেকে বামেরা প্রশ্ন তুলছেন, তার মানে অশোকবাবুর জন্য সাক্ষাতের সময় যে নির্ধারিত হয়েছিল, সরকারি সূত্রেই তা মেনে নেওয়া হচ্ছে! সুতরাং, মন্ত্রীরা সচেতন ভাবেই অশোকবাবুকে এড়িয়ে গিয়েছেন।

অশোকবাবুর কথায়, ‘‘উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবের সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে আমি নিজে চিঠি দিয়েছিলাম। ওঁর ব্যক্তিগত সচিব চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, ৮ জুন মন্ত্রীর সময় হবে। মন্ত্রী শিলিগুড়িতেই থাকেন! জবাবটাও নিজে দেননি। এগুলো কি সৌজন্য?’’ মন্ত্রী গৌতমবাবু অবশ্য এ দিনের ঘটনা সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘বিধানসভার অধিবেশন চললে মন্ত্রীরা ব্যস্তই থাকেন। পুরসচিব ওঁর (অশোকবাবু) সঙ্গে কথা বলেছেন। বিধানসভায় কলকাতা পুরসভা সংক্রান্ত একটি বিলও ছিল এ দিন। পুরমন্ত্রী সেই বিল পেশ করেছেন। উনি খুবই ব্যস্ত ছিলেন।’’ অধিবেশনে মন্ত্রীরা ব্যস্ত থাকেন বললেও স্বয়ং গৌতমবাবুকে অবশ্য গত কয়েক দিনে বিধানসভায় দেখা যায়নি!

এই চাপানউতরে একটি ইঙ্গিতই স্পষ্ট! ফিশফ্রাই কূটনীতি এখন অতীত!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement