Vegetables Price Hike

‘লকারে থাকুক’, সব্জিতে হাত দিয়ে ছ্যাঁকা খেতে খেতেও রসিকতা বাজারে, সোমে নামবে টাস্ক ফোর্স

নবান্ন জানিয়েছিল, টাস্ক ফোর্স বাজারে ঘুরে নজরদারি চালাবে। পাশাপাশি, সুফল বাংলার ভ্রাম্যমাণ স্টলে সাধারণ বাজারদরের থেকে অন্তত ৫-১০ টাকা করে কম দামে আনাজপাতি পাওয়া যাবে।

Advertisement

প্রচেতা পাঁজা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৩ ১৮:০৬
Share:

প্রতীকী ছবি।

রবিবার সকাল থেকেই গরম ছিল একটু বেশি। কিন্তু বাজার করতে বেরিয়ে বাঙালির প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠল। চারপাশে আগুন জ্বলছে! আদা, টম্যাটো, কাঁচালঙ্কা— কিছুতেই হাত ছোঁয়ানো যাচ্ছে না। হাত দিলেই ছ্যাঁকা লাগছে। শনিবার পর্যন্ত লঙ্কার দাম ৩০০ টাকা কেজি ছিল। রবিবারের সকালে তা আরও বেড়ে হয়েছে কেজিপ্রতি ৩৫০ টাকা। মানিকতলা বাজার, গড়িয়াহাটের বাজার— সর্বত্রই এক হাল। অন্য দিকে, লঙ্কার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে রান্নার আরও এক অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ আদা। নিরামিষ রান্না হোক বা আমিষ, আদা সর্বত্রই প্রয়োজন। টম্যাটো ছাড়া তবু রান্না হতে পারে। কিন্তু আদা জরুরি। অথচ, সেই আদাও এখন ৩৫০ টাকা কেজি দরে বিকোচ্ছে। শনিবার কোথাও কোথাও ৪০০ টাকাতেও বিক্রি হয়েছে আদা। যে আদা বছরের অন্য সময়ে ১৫০-২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।

Advertisement

রবিবার ছিল মাসের প্রথম রবিবার। সাধারণত রবিবারের বাজার মানেই সময় নিয়ে গুছিয়ে কয়েক দিনের বাজার করা। ‘ভাল’ কিছু পাওয়া গেলে বাছবিচার না করে কিনে ফেলা। তার উপর মাসের শুরু মানে গৃহস্থের পকেট ভারী। বিক্রিবাটা কিছু বেশিই হয় এমন দিনে। কিন্তু মানিকতলার বাজারে দেখা গেল রবিবারের সেই ভিড়ে কিছুটা টান। আসার থেকে যাওয়ার তাড়াই বেশি বাজার করতে আসা মানুষের। বাজার ঘুরে থলে না ভরেই বাড়ি ফেরা একজন বলেই ফেললেন, ‘‘আনাজপাতি এখন সোনার মতো লকারে ভরে রাখতে হবে। খাওয়া যাবে না আর।’’

রবিবারের বাজারদর

Advertisement

গত কয়েক দিন ধরেই বাজার অগ্নিমূল্য। রবিবার সেই আঁচ ছিল আরও কিছুটা বেশি। পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৬০ টাকা কেজি, রসুন ২০০ টাকা কেজি, আলু ২০-৩০ টাকা কেজি (সাধারণ ১৬ টাকা কেজি থাকে), পটল ৬০ টাকা কেজি, বেগুন ১৫০ টাকা কেজি, ঢ্যাঁড়স ৬০-৭০ টাকা কেজি, উচ্ছে ১০০ টাকা কেজি, সজনে ডাঁটা ১০০-১২০ টাকা কেজি, ক্যাপসিকাম ১৫০ টাকা কেজি, গাজর ৭০ টাকা কেজি, বাঁধাকপি ৪০-৫০ টাকা কেজি, ফুলকপি ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। দোকানদারেরাই জানাচ্ছেন, প্রায় সব জিনিসেরই দাম অন্তত ১০-২০ টাকা বেড়েছে। এ দিকে শসা ৮০ টাকা কেজি দরে কিনে ৮০ টাকাতেই বিক্রি করতে হচ্ছে বলে জানালেন এক দোকানি। তাঁর কথায়, ‘‘লাভ রাখতে পারছি না। শসা ১০০ টাকা কেজি বললে কেউ আর নিচ্ছে না। এ তো আর এমন জিনিস নয় যে, খেতেই হবে!’’ মানিকতলা এবং গড়িয়াহাটের বাজারের পরিস্থিতি মোটামুটি। শহরতলির বাজারগুলিতেও দামের খুব একটা ফারাক নেই।

নবান্ন কী জানিয়েছিল

এই পরিস্থিতিতে জেলায় জেলায় টাস্ক ফোর্স নামানোর ঘোষণা করেছে নবান্ন। শনিবারই রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী এ ব্যাপারে বৈঠক করেছিলেন। তার পরেই নবান্নের তরফে জানানো হয়েছে, এই টাস্ক ফোর্স বাজারে বাজারে ঘুরে নজরদারি চালাবে। পাশাপাশি সুফল বাংলার ভ্রাম্যমাণ স্টলে সাধারণ বাজারদরের থেকে অন্তত ৫-১০ টাকা করে কম দামে আনাজপাতি পাওয়া যাবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে সোমবার থেকে এই ব্যবস্থাও চালু হবে বলে ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার।

গ্রাফিক— সনৎ সিংহ

বিরোধীরা কী বলছে

তবে রাজ্য যা-ই বলুক, পঞ্চায়েত ভোটের আগে খাবার জিনিসের এই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরব হয়েছে বিরোধীরা। রাজ্যের বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী একটি ফেসবুক পোস্ট করে মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁরই সুরে কটাক্ষ করেছেন। কেন্দ্র যখন রান্নার গ্যাসের দাম উত্তরোত্তর বাড়িয়ে চলেছে, তখন মমতা তাঁর ধর্না মঞ্চ থেকে বলেছিলেন, ‘‘আরে ও নন্দলাল, ১০০০ টাকার গ্যাসে ফুটছে বিনা পয়সার চাল?’’ রবিবার শুভেন্দু তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘‘আরে ও নন্দলাল, গরিব মানুষের পাতে কি জুটবে শুধু নুনের সঙ্গে মোদীজির দেওয়া বিনা পয়সার চাল?’’ একই সঙ্গে শুভেন্দুর সংযোজন, ‘‘আনাজের দাম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে টাস্ক ফোর্স গঠন করেছিলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল হঠাৎ করে বাজারহাটে শাকসব্জির দাম বেড়ে গেলে, তা নিয়ন্ত্রণ করা, কিন্তু আদতে তার প্রতিফলন কখনওই দেখা যায় না।’’ মুখ্যমন্ত্রীর সুফল বাংলায় কম দামে আনাজ বিক্রির সিদ্ধান্তকে কটাক্ষ করেও শুভেন্দু বলেন, ‘‘হাটেবাজারে আগুন লেগেছে। আর লোকদেখানো পদক্ষেপ করে আনাজের দাম শুধুমাত্র সুফল বাংলা বিপণিতে কিছুটা কমালে তার প্রভাব ৫ শতাংশ মানুষের উপরেও পড়ে না।’’

তৃণমূল কী বলছে

শুভেন্দু যেদিন বাজারের আনাজপাতির মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকারকে দুষেছেন, সেদিনই সুজাপুরের জনসভা থেকে পাল্টা শুভেন্দুর দল তথা কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপিকে পাল্টা আক্রমণ করেছেন অভিষেক বন্দ্য়োপাধ্যায়। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকও বিজেপিকে তোপ দেগেছেন মূল্যবৃদ্ধি নিয়েই। তবে তাঁর আক্রমণের বিষয় ছিল রান্নার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি। কেন্দ্রের শাসকদলকে তাঁর প্রশ্ন, রাজ্যে আনাজের দামবৃদ্ধি নিয়ে সরব হচ্ছে বিজেপি। অথচ বিজেপি শাসিত দেশে দিনের পর দিন গ্যাসের দাম বেড়ে চলেছে। সেটা কী করে হচ্ছে?তখন রাজ্যের বিরোধী তথা দেশের শাসকদলের প্রতিনিধিরা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কোনও কথা বলছেন না কেন।

মুখ্যমন্ত্রী কী বলেছিলেন

সবজির দাম বৃদ্ধি নিয়ে শনিবার নাম না করে কেন্দ্রকে আক্রমণ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। গোটা দেশ জুড়েই টোম্যাটো-সহ বিভিন্ন আনাজের দাম বেড়েছে বাজারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত গরম, বর্ষা দেরিতে আসা এবং টম্যাটোর উৎপাদন কম হওয়ায় দাম বেড়েছে। মূলত দক্ষিণের রাজ্যগুলি থেকেই টম্যাটো আসে বাংলায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টম্যাটো বাংলায় আসে কর্নাটক থেকে। কিন্তু সেখানেও টম্যোটোর মজুতকরণ-সহ কৃষি সংক্রান্ত অন্যান্য সমস্যার জন্য বাংলায় যে পরিমাণ ফসল আসার কথা ছিল, তা আসছে না। শনিবার জলপাইগুড়ির ক্রান্তিতে জনসভা ছিল মমতার। সেই সভা থেকেই এই সমস্যার জন্য কেন্দ্রকে আক্রমণ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেন, “মুম্বইয়ে টোম্যাটোর দাম ১২০ টাকা কেজি, দিল্লিতে দাম ১০০ টাকা কেজি। টোম্যাটোর জন্য সহায়ক মূল্যও কেন্দ্র দেয় না। আমার এখানে কৃষকদের কোনও সমস্যা হলে, আমি দেখে নিতাম।” নাম না করেও মমতা বুঝিয়ে দেন, কর্নাটকের আগের বিজেপি সরকার এ ব্যাপারে ব্যর্থ।

কেন বাড়ছে দাম

প্রশাসন সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, এ বছর গরম বেশি হওয়ায় অনেক সব্জিরই ফলন কম হয়েছে। অতিরিক্ত গরমে এবং বৃষ্টি সে ভাবে না হওয়ায় শুকিয়ে নষ্ট হয়েছে গাছ। বিশেষ করে এ বার বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে যে ভাবে মাত্রাছাড়া গরম বেড়েছিল, তাতে লঙ্কা চাষ ব্যাহত হয়েছে। বৃষ্টির অভাবে সেচের মাধ্যমে জল দেওয়ার প্রয়োজন পড়লেও বহু লঙ্কাচাষিই পাম্প চালিয়ে সেই অতিরিক্ত জলের ব্যবস্থা করার খরচ টানতে পারেননি। ফলত ফলন কম হয়েছে। আর তার প্রভাব পড়েছে দ্রব্যমূল্যেও। তবে এ ছাড়াও আরও একটি কারণ দাম বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সাধারণত বাজারদরের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ হয় ফড়েদের মাধ্যমে। রাজ্যে বাজারদরের দেখাশোনা করে যে বিভাগ, সেই এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ বা ইবির কর্মীদের তাই বাজার পরিদর্শন করতে বলা হয়েছে। তাঁরা দেখবেন কোথাও বেআইনি ভাবে মজুতকরণ করে ইচ্ছে করে দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে কি না।

দোকানদারেরা কী বলছেন

অনেকেরই মত, পঞ্চায়েত ভোটের জন্যই দাম বাড়ছে সব্জির। তবে এ ছাড়াও আদার দাম বৃদ্ধির জন্য আরও একটি কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন দোকানিরা। তাঁদের মতে, রাজ্যে আদার ফলন হয় ঠিকই, কিন্তু সেই আদার মান ভাল নয়। ভাল জাতের আদা আসে মণিপুর থেকে। কিন্তু মণিপুরে এখন অশান্তি চলছে। তাই সেখান থেকে আদা এসে পৌঁছচ্ছে না। আদার দাম বৃদ্ধির একটা বড় কারণ সেটাও হতে পারে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement