বিজয়ী: নিকোলাস কোলরিজের হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন প্রশান্ত শশীকান্ত পাটিল। পাশে রাখী সরকার। শনিবার শহরের এক পাঁচতারা হোটেলে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
শান্তিনিকেতনে সাঁওতালরা বাড়ির আত্মজন, এমনকি, পোষ্য মারা গেলেও খড়ের দড়ি তৈরি করে তা দিয়ে মৃতদেহ পেঁচিয়ে রাখতেন। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনার সুবাদে সে-সব দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। নিজের শিল্পেও সচেতন ভাবে ব্যবহার করেছেন সে দড়ি। অ্যালুমিনিয়াম রডের তৈরি টেলিভিশনের অ্যান্টেনার উপরে খড়ের দড়ি পাকিয়ে রাখা ফাইবার গ্লাসের তৈরি মৃতদেহ। এখনকার যাবতীয় শব্দ, দৃশ্য শুধু কি হত্যা-সংবাদ বয়ে আনছে যা হয়ে উঠছে সর্বোচ্চ বিনোদনের মাধ্যম?
শান্তিনিকেতন থেকে ভাস্কর্য নিয়ে স্নাতকোত্তর পাশ করা শুভাণ্বিতা সাহা নিজের ‘ওয়ার অ্যান্ড এন্টারটেনমেন্ট’ শিল্পকর্মে সে প্রশ্নই তুলে দিয়েছিলেন। যে প্রশ্নকে স্বীকৃতি দিল সিমা (দ্য সেন্টার অব ইন্টারন্যাশনাল মডার্ন আর্ট)। শনিবার ২০১৯ সালের সিমা অ্যাওয়ার্ড শো-র তৃতীয় সংস্করণে শুভাণ্বিতা হলেন ‘প্রথম রানার আপ’।
এক দিকে শিল্প ও শিল্প প্রকাশের জন্য শিল্পীর নিরন্তর অন্বেষণ। অন্য দিকে, প্রথা ভাঙা চিন্তা ও সেই চিন্তাকে প্রকাশের জন্য শিল্পীর সৎ প্রচেষ্টা—বহমান বহুমুখী চিন্তাস্রোতকে বরাবরই স্বীকৃতি দিয়ে এসেছে সিমা। সিমার ডিরেক্টর রাখী সরকারের এ দিনের বক্তব্যের নির্যাসও সেটা। তিনি এ দিন বললেন, ‘‘নবীন শিল্পীরা নতুন ভাবে জীবনকে দেখেছেন। আর সেই দেখাকেই প্রচলিত মাধ্যম থেকে শুরু করে নতুন মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।’’
শিল্পীর সৃজনশীলতাকে রক্ষা ও সকলের সামনে তুলে ধরার জন্য সমাজের একটি বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে—সিমার ডিরেক্টর বরাবরই এই নীতিতে বিশ্বাসী।
তাই সারা দেশে একমাত্র সিমা অ্যাওয়ার্ডেই ভাস্কর্য, চিত্রকলা, ফটোগ্রাফি থেকে শুরু করে ভিডিয়ো-সহ বিবিধ মাধ্যমে প্রকাশিত শিল্পকর্মের আবেদনকে গ্রহণ করা হয়। যেমনটা নবীন শিল্পী অনুপম বসুর ভিডিয়ো মাধ্যমে কাজ ‘কোরাস’, এ বছর সিমার ‘দ্বিতীয় রানার আপ’। অনুপমের কথায়, ‘‘এই স্বীকৃতি আমাদের মতো নবীন শিল্পীদের কাছে বাড়তি অক্সিজেন।’’ বহুমুখী সব শিল্পকর্ম সিমা গ্যালারি, ডোভার টেরেসের স্টুডিয়ো ২১ ও জেম সিনেমায় আগামী ২৩ তারিখ পর্যন্ত দেখা যাবে।
নবীন শিল্পীদের পাশাপাশি শিল্পের সংরক্ষণের জন্য ডেবোরা সোয়ালো, অঞ্জনিকুমার সিংহ, পূজা সুদের মতো কিউরেটরদেরও এ দিন সম্মানিত করা হল। এ দিনের সিমা-মঞ্চে দেশের একাধিক রাজ্যের শিল্পীরা উপস্থিত হয়েছিলেন। পাশাপাশি লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামের চেয়ারম্যান নিকোলাস কোলরিজ-সহ একাধিক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে পাঁচতারা হোটেলের বলরুম ছিল আক্ষরিক অর্থেই নক্ষত্রখচিত। সারা বিশ্বে অসহিষ্ণু-আবহ থেকে শুরু করে শিল্পীর স্বাধীনতার প্রসঙ্গ আবার উঠে আসে নিকোলাসের বক্তব্যে। নিকোলাস বলেন, ‘‘সেরা শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে শিল্পীর স্বাধীনতা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।’’
আর সেই স্বাধীনতাকেই প্রাধান্য দেয় সিমা। দ্বিবার্ষিক পুরস্কার অনুষ্ঠানে ‘স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড’, ‘স্পেশাল মেনশন অ্যাওয়ার্ড’, ‘মেরিট অ্যাওয়ার্ড’-সহ একাধিক বিভাগে আরও ১৫ জন শিল্পীকে পুরস্কৃত করা হয়। জুরি অ্যাওয়ার্ড পেলেন জিন্টু মোহন কলিটা ও পৃথ্বীরাজ মালি।
‘‘এক জন শিল্পীর জন্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া, ঘোরাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ’’, অ্যাওয়ার্ড শো-র আগে কথাগুলো বলছিলেন প্রশান্ত শশীকান্ত পাটিল। চিত্রকলা নিয়ে পড়তে মহারাষ্ট্র থেকে শান্তিনিকেতনে উড়ে এসেছিলেন ছাব্বিশ বছরের এই যুবক। পাশও করেছেন সেখান থেকে। ২০১৯ সালের সিমা অ্যাওয়ার্ডের বিজেতা তিনিই। প্রশান্তের হাতে পাঁচ লক্ষ টাকার চেক ও ট্রফি তুলে দিলেন রাখী সরকার ও নিকোলাস কোলরিজ।
প্রশান্ত আরও বলছিলেন, ‘‘আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে চিন্তায় শান্তিনিকেতন তৈরি করেছেন, সেটাই তো সব থেকে বড় থেকে শিল্প!’’ আর মঞ্চে উঠে লাজুক প্রশান্ত বললেন, ‘‘এটা আমার জীবনের প্রথম পুরস্কার। আজকের এই পুরস্কার শান্তিনিকেতনের জন্য পেয়েছি।’’ সমস্ত বলরুম জুড়ে তখন হাততালির কলরোল।
আর সেই কলরোলের মধ্যেই সমস্ত গণ্ডি ভেঙে শনিবারের সিমা-মঞ্চে ভিন রাজ্য, বাংলা ও রবীন্দ্রনাথ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল!