আটক হওয়া সেই গাড়ি।
টোল ফাঁকি দেওয়ার মানসিকতাই কাল হল। গাড়িতে ‘অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড’-এর ফলক বেআইনি ভাবে ব্যবহার করে বর্ধমানে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেল তিলজলার ছয় যুবক। রবিবার ভোরের ঘটনা। তাদের মনে হয়েছিল, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ওই পরিচয়জ্ঞাপক ফলক গাড়িতে লাগালে জাতীয় সড়কের কোথাও টোল দিতে হবে না। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তারা এখন প্রতারণা ও গাড়ি চুরির মামলার মুখোমুখি। আপাতত তারা জামালপুর থানার লকআপে।
পুলিশ জেনেছে, শনিবার রাতে ওই যুবকেরা কোলাঘাটের উদ্দেশে বেরিয়েছিল। কিন্তু প্রচুর মদ্যপানের পর তারা কোনা এক্সপ্রেসওয়ে থেকে বম্বে রোড না ধরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে গিয়ে পড়ে। রাস্তা ভুল করাও তাদের পুলিশের হাতে ধরা পড়ার অন্যতম কারণ।
রবিবার সারা দিনের জেরায় ওই যুবকদের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানার পর পুলিশ যেন কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কারণ, পঠানকোটের বায়ুসেনা ঘাঁটিতে হামলা চালানো জঙ্গিরা পুলিশের একটি গাড়ি ছিনতাই করেছিল। তাই, রবিবার ভোরে বর্ধমানের জামালপুরের আঝাপুর মোড়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের উপর ওই সাদা গাড়ি আটক করা ইস্তক প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, সেনা, কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)— সব জায়গায় খবর পাঠানো হয়েছিল।
গাড়ির সামনে-পিছনে নম্বরপ্লেটের ঠিক উপরে লাল রঙের বোর্ড। তাতে সোনালি হরফে লেখা ‘গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স, ওএফবি, কলকাতা’। গাড়িতে ছ’জন যুবককে গাদাগাদি করে বসে থাকতে দেখে সন্দেহ হয় পুলিশের। তারা জানায়, তাদের গন্তব্য সেনাবাহিনীর পানাগড় বেস ক্যাম্প। কিন্তু পরিচয়পত্র বা গাড়ির নথি তারা দেখাতে পারেনি। এতে সন্দেহ আরও বাড়ে। পুলিশের একাংশ এটাও ভেবে ফেলে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের গাড়ি কোনও ভাবে হাতিয়ে হামলার ছক কষা হচ্ছিল। পরে অবশ্য জানা যায়, ভাড়ার গাড়িটি গত নভেম্বর পর্যন্ত ওএফবি বা অর্ডন্যান্স বোর্ড ফ্যাক্টরির এক অফিসার ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তার পর প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
পুলিশ জানিয়েছে, ধৃতদের নাম শাকির আহমেদ, সেলিম আখতার, শেখ ইরফান, শেখ আনসারুদ্দিন, আব্দুল আখতার ও শেখ শাহরুখ। এদের মধ্যে শাকির গাড়ির চালক। শাকিরের বিরুদ্ধে বছর পাঁচেক আগে কলকাতায় মারধর ও অন্যকে অবৈধ ভাবে আটকে রাখার অভিযোগে মামলা রুজু করা হয়েছিল।
আদালতের পথে ধৃতেরা।ছবি: উদিত সিংহ।
তদন্তে জানা গিয়েছে, বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য কলকাতার রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট অফিসে গাড়িটি নথিভুক্ত। মালিকের নাম আবদুল কাদের নওয়াজ খান। ধৃত যুবকেরাও আসল উদ্দেশ্যের কথা জানায়। বর্ধমানের পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল বলেন, ‘‘কলকাতা পুলিশ ও প্রতিরক্ষা দফতরে ঘটনাটি জানানো হয়েছে। ধৃতদের বক্তব্যের সত্যতা জানতে বর্ধমান পুলিশের একটি দল তিলজলা থানায় গিয়েছে।’’
কলকাতায় সেনাবাহিনীর মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক উইং কম্যান্ডার এস এস বিরদি বলেন, ‘‘এই গাড়িটি অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড (ওএফবি)-এর এক অফিসার ব্যবহার করতেন। এক ট্র্যাভেল এজেন্সির সঙ্গে আমাদের চুক্তি ছিল। তারাই গাড়ি পাঠায়। ২০১৫-র নভেম্বরে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়।’’
ওই ট্রাভেল এজেন্সির মালিক মহুলবন্ধু নিয়োগী জানান, ওএফবি-র নির্দেশে গাড়ির মালিক আবদুল কাদের নওয়াজ খানকেই বলা হয়েছিল, ওএফবি-র ফলক তৈরি করে গাড়িতে লাগিয়ে নিতে। ওএফবি-র চুক্তি শেষ হওয়ার পরে অন্য একটি সরকারি অফিসে এই গাড়িটি চলছিল।
এ দিন গাড়ির মালিক আবদুল জানান, চালক শাকিরকে তিনি গাড়ি থেকে সেনাবাহিনীর ওই বোর্ড খুলে নিতে বলেছিলেন, কিন্তু শাকির কথা শুনত না। আবদুলের কথায়, ‘‘শাকির নিজের কাছে গাড়ি রাখে। আমি রোজ নজর রাখতে পারি না।’’
আবদুল জানান, এখন যে সরকারি অফিসে তাঁর গাড়ি ভাড়া খাটছে, সেই অফিসের এক কর্তাকে রবিবার সন্ধ্যায় কলকাতা বিমানবন্দর থেকে আনতে যাওয়ার কথা ছিল শাকিরের। কিন্তু তিনি বিমানবন্দরে নেমে শাকিরের খোঁজ পাননি।
তখনই খোঁজ পড়ে গাড়ির। আবদুলের কথায়, ‘‘বহু বার শাকিরকে ফোন করেও পাইনি। অনেক রাতে শাকিরের ভাই ফোন করে বলে, শাকিরকে পুলিশ ধরেছে।’’
কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রক বা সেনার নামে তৈরি এই ধরনের ফলক গাড়িতে লাগিয়ে কোনও বিপজ্জনক কাজ, এমনকী জঙ্গি হামলাতেও তো ব্যবহার করা যেতে পারে! সেনা সূত্রে অবশ্য বলা হয়েছে, চুক্তি শেষ হওয়ার পরে ওই বোর্ড গাড়ির মালিক না খুললে দায় তাদের নয়!