জয়ন্ত সিংহ। — ফাইল চিত্র।
ব্যক্তিগত মালিকানার বিশাল জমির এক পাশে ছিল দরমা-বেড়ার ক্লাব। স্থানীয় যুবকেরা সেই মাঠে খেলতেন। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে যেমন সেই ক্লাব কংক্রিটের হয়েছে, তেমনই বদলেছে ‘মালিকানা’। আর একটা সময়ের পরে স্থানীয় প্রভাবশালীর ছত্রচ্ছায়ায় থাকা ‘জায়ান্ট’ ক্ষমতার জোরে, আড়িয়াদহের সেই তালতলা ক্লাবকে নিজের ‘আদালত’ বা ‘কার্যালয়’ করে তুলেছে।
৫০ বছরেরও বেশি পুরনো যে তালতলা স্পোর্টিং ক্লাব নিয়ে এক সময়ে স্থানীয়েরা গর্ব করতেন, এখন সেটাই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবিতে সরব বাসিন্দাদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, “অপরাধী তৈরির আঁতুড়ঘর ভেঙে দেওয়াই দরকার।” আড়িয়াদহের নওদা পাড়া এলাকায় তিনটি ভাগে বিভক্ত আবাসনের নীচে রয়েছে ওই ক্লাব। পাশে পুরসভার বাজার। আবাসনের ভিতরে বিশাল জলাশয় ও গাছপালা। জানা যাচ্ছে, জয়ন্ত সিংহের প্রাথমিক উত্থানের নেপথ্যে যে স্থানীয় প্রোমোটারের কথা উঠে এসেছে, ওই গোটা জমির মালিক তাঁর পরিবার।
সূত্রের খবর, এক সময়ে রাস্তার উপরেই স্থানীয় বাজার বসত। ২০০৬ সালে সাড়ে ২৬ কাঠা জমি কামারহাটি পুরসভাকে স্থায়ী বাজার তৈরির জন্য দেয় ওই প্রোমোটারের পরিবার। সেই সময়ে তালতলা স্পোর্টিং ক্লাবের তরফে পুরসভার কাছে জায়গা চাওয়া হয়। পুরসভা একটা জায়গাও দেয়। বাম আমলের সেই সময়ে স্থানীয় পুরপ্রতিনিধিদের অনেকেই সভাপতি, সম্পাদক পদে থেকেছেন। জানা যাচ্ছে, ২০০৯ থেকে ওই জমিতে আবাসন তৈরির কাজ শুরু হয়। যেটি করেছিলেন জয়ন্তর ‘স্থানীয় অভিভাবক’ বলে পরিচিত প্রোমোটার রাজু ঘোষ। ২০১৪ সালে কাজ শেষ হয় পুরবাজারের এবং ওই সাড়ে ২৬ কাঠা জমির উপরে গড়ে ওঠে আবাসন। বাজারের পাশে আবাসনের নীচে পাকা ক্লাবঘরও দেওয়া হয়। অভিযোগ, ওই সময় থেকে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের সূত্রে ওই প্রোমোটারের সঙ্গে পরিচয় জয়ন্তের।
আড়িয়াদহে ফুটবলার ও দুধবিক্রেতা বলে পরিচিত জয়ন্ত তখনও ‘জায়ান্ট’ হয়ে ওঠেনি। বরং সে বাড়িতে শাড়িতে ব্লক প্রিন্টিংয়ের ব্যবসা শুরু করেছিল বলেই দাবি পরিজনের। বছর দুয়েকের মধ্যে সেই ব্যবসা বন্ধ করে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহ শুরু করে জয়ন্ত। এর বছর খানেকের মধ্যে প্রোমোটিং ব্যবসায় ঢুকে পড়ে ‘জায়ান্ট’। সূত্রের খবর, ২০১৮ থেকে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতার চোখে পড়ে যায় জয়ন্ত। তখন থেকেই সে নিজেকে ‘বাহুবলী’ হিসেবে তৈরি করতে শুরু করে।
রাজ্যে পালাবদলের পরে তালতলা ক্লাবও শাসক দলের হাতে চলে যায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, ২০১১ সালে ক্লাবের ক্ষমতা বদল হওয়ার পরেও এতটা খারাপ অবস্থা ছিল না। কিন্তু ‘জায়ান্ট’ ক্লাবকে নিজের কব্জায় নিতেই নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে ক্লাব। স্থানীয় প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক মানস মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘২০১৮ নাগাদ জয়ন্তদের উত্থানের পর থেকে দুষ্কৃতীদের আখড়া হয়ে গেল।’’ যদিও এখনও তালতলা ক্লাব বছরে একটা ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সেই প্রতিযোগিতা ‘ক্ষমতা’র প্রদর্শন, অভিযোগ স্থানীয় মহলের।
যে প্রোমোটারের হাত ধরে জয়ন্তের বাড়বাড়ন্ত বলে অভিযোগ, সেই রাজু দায় এড়াতে পারেন না বলে এখন অভিযোগ তুলছেন বিধায়ক মদন মিত্র। বলছেন, ‘‘নিজের প্রোমোটিং ব্যবসার বেআইনি কাজে জয়ন্তের মতো ছেলেদের ব্যবহার করতেন ওই প্রোমোটার। তাঁদের জমিতে ক্লাব। তাই রাজু ঘোষেরও ক্লাবের অনৈতিক কাজে নৈতিক দায় থেকে যায়।’’ যদিও রাজুর স্পষ্ট দাবি, তিনি জয়ন্তকে চিনতেন ফুটবলার হিসেবে। সে ভাবেই স্থানীয় নেতাদের সঙ্গেও পরিচয় করিয়েছিলেন। আর, জমিটা পুরসভাকে তাঁরা দিয়ে দিয়েছেন। সেই অংশে ক্লাব। তাই তালতলা ক্লাবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নেই। তবে বছরে এক বার তাঁর বাবা ও দাদুর নামাঙ্কিত ফুটবল টুর্নামেন্টে তিনি যেতেন। রাজু বলেন, ‘‘সকলেই ওই খেলায় যেমন যেতেন, আমিও যেতাম। এর বাইরে জয়ন্তের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল না। আমার ব্যবসার সঙ্গেও জয়ন্তের সম্পর্ক নেই। তাই কে কী অভিযোগ করছেন, তা নিয়ে কিছু বলতে পারব না।’’
প্রসঙ্গত, জয়ন্ত এবং তার শাগরেদদের অনেকেই গ্রেফতার হলেও আরও দুই-তিন জনের খোঁজ চালাচ্ছে পুলিশ। পুলিশ সূত্রে খবর, গ্রেফতারি থেকে বাঁচতে শুক্রবার নিজের বিয়ের আসরেই আসেনি তেমনই এক শাগরেদ রাহুল গুপ্ত। সম্প্রতি মারধরের যে ভিডিয়ো (আনন্দবাজার পত্রিকা সত্যতা যাচাই করেনি) ভাইরাল হয়েছে, তাতে ওই ক্লাবের ভিতরে চোর সন্দেহে যাকে বেধড়ক মারা হচ্ছে, তাকে নিয়ে আসে রাহুলই। জানা যাচ্ছে, আড়িয়াদহেরই এক তরুণীর সঙ্গে আগেই ‘এনগেজমেন্ট’ হয়েছিল রাহুলের। ওই দিন ছিল বিয়ের অনুষ্ঠান। রাহুলকে ধরতে পুলিশও পৌঁছে যায়। যদিও রাহুল আসেনি। বরং ভিন্ রাজ্য থেকে আসা আত্মীয়রা অনুষ্ঠানস্থলে এসেও তড়িঘড়ি ফিরে যান।