Student Movement

আগুনখেকো ছাত্রনেতারা কি ক্যাম্পাস পেরোলে নিভে যান? বিপ্লব ছেড়ে চলে যান বিলাসে? খুঁজল আনন্দবাজার ডট কম

যাঁরা আজ বলছেন ‘রাষ্ট্র শোষণযন্ত্র’, তাঁরা কি ভবিষ্যতে বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে থাকবেন? না কি মৌতাত চলে গেলে তাঁরাও বিপ্লব ছেড়ে চলে যাবেন বিলাসে? মিছিল-প্যান জিবি ছেড়ে আলোচনা করবেন চাকরির বার্ষিক প্যাকেজ নিয়ে?

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২৫ ০৯:০১
Share:
Are student movement leaders involved in mainstream politics, How is the reality

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

ক্যাম্পাসে বিপ্লবস্পন্দিত বুকে স্লোগান তুলে যাঁরা নিজেদের ‘আমিই লেনিন’ ভাবেন, তাঁরা কি শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে থাকেন? না কি মরসুমি বিপ্লবের মৌতাত, দিনবদলের মোহ ঘুচে যাওয়ার পরে অনুভব করেন, জীবন বড় কঠিন। যৌথখামার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন এবং বাস্তবের ফারাক আলোকবর্ষ সমান। অতএব, বিপ্লব অনেক হয়েছে। এ বার ‘নেশা’ ছেড়ে বেছে নিতে হবে পেশা। ক্যাম্পাসের পাট চুকে যাওয়ার পরেই কি বিপ্লব হয়ে যায় ‘অধরা মাধুরী’?

Advertisement

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের পরে নানা পরিসরে পুরনো সেই প্রশ্ন নতুন করে আলোচিত হচ্ছে। যাঁরা আজ বলছেন ‘রাষ্ট্র শোষণযন্ত্র’, তাঁরা কি বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে থাকবেন? না কি মৌতাত চলে গেলে তাঁরাও বিপ্লব ছেড়ে চলে যাবেন বিলাসে? মিছিল-প্যান জিবি ছেড়ে আলোচনা করবেন চাকরির বার্ষিক প্যাকেজ নিয়ে?

পুরনো প্রশ্ন নতুন করে উস্কে দেওয়ার নেপথ্যে রয়েছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু স্বয়ং। যিনি যাদবপুরে ২০২৫ সালের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কারণ। যাঁকে ঘিরে গত ১ মার্চ রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল যাদবপুর ক্যাম্পাস। যাঁর বিরুদ্ধে একযোগে বাম ছাত্র সংগঠনগুলির অভিযোগ, মন্ত্রী গাড়ি দিয়ে পিষে মারার চেষ্টা করেছিলেন এক ছাত্রকে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা যে ছাত্রের বয়ানের ভিত্তিতে হাই কোর্টের নির্দেশে ব্রাত্য-সহ আরও কয়েক জনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করতে হয়েছে পুলিশকে।

Advertisement

গত শনিবার তৃণমূলের শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুপার বার্ষিক সাধারণ সভায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন ব্রাত্য। শুরু থেকেই ব্রাত্যকে ঘিরে বিক্ষোভ শুরু হয়। একাধিক ভিডিয়ো ফুটেজ দেখিয়ে শাসকদল তৃণমূল দাবি করেছে, যাদবপুরের বাম ছাত্রেরা কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করেছেন। ওই অনুষ্ঠানেই ব্রাত্যের বক্তৃতার একটি অংশ সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে ব্রাত্য বলছেন, ‘‘যাদবপুরে চার বছর আগে যে আন্দোলন হয়েছিল, তার নেতারা কি আজ আছেন? তাঁদের আপনি দেখতে পাবেন না। তাঁদের দেখতে পাবেন যুক্তরাষ্ট্রে বা বেঙ্গালুরুতে। তাঁদের এ রাজ্যের জন্য কিছু যায়-আসে না। তাঁদের পাশের বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন, কোনও দিন কোনও অসুস্থের জন্য রাতে অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে দিয়েছেন কি না। উত্তর, না। কোনও দিন তিনটি বাড়ি পরে কারও কন্যাশ্রীর ফর্ম পূরণে সাহায্য করেছেন কি না। উত্তর হচ্ছে না।’’

এমন বিবিধ উদাহরণ দিয়ে ব্রাত্য বোঝাতে চেয়েছেন, ওই ছাত্রনেতারা শিক্ষায়তনে আসেন, দু’-তিন বছর থাকেন, প্রচারের আলো কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তার পরে সব ছেড়ে বিলাসের জীবন বেছে নেন। দেশ বা দশ নিয়ে তাঁরা ভাবেন না।

বাস্তব বলছে ব্রাত্য পুরো ভুল নন। আবার পুরো ঠিকও নন। অর্থাৎ, ব্রাত্য ‘একমুখী’ মন্তব্য করেছেন। বাস্তব ভিন্ন। তার নানা উদাহরণ রয়েছে যাদবপুরের ক্যাম্পাস রাজনীতির গত তিন দশকের ইতিহাসেই। শুধু যাদবপুর নয়। গোটা রাজ্যের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসেই এই বাস্তব ‘দ্বিমুখী’। অর্থাৎ, যাঁরা ছাত্র আন্দোলন করেছেন বা ছাত্রনেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তাঁদের অনেকে থেকে গিয়েছেন সর্ব ক্ষণের রাজনীতিতে। কেউ কেউ পেশার জন্য অন্যত্র চলে গেলেও ‘রাজনৈতিক সংশ্রব’ রেখেছেন। আবার কেউ কেউ এমনও আছেন, যাঁরা ক্যাম্পাসের গণ্ডি পার করার পরেই রাজনীতি থেকে চলে গিয়েছেন বহু দূরে।

গত দু’দশকে যাদবপুরে যে ক’টি আন্দোলন আলোড়ন তৈরি করেছিল, তার মধ্যে অন্যতম ২০০৫ সাল। সে বার ক্যাম্পাসের ভিতরে ঢুকে আন্দোলনরত ছাত্রদের পিটিয়েছিল তৎকালীন বাম সরকারের পুলিশ। সেই আন্দোলনে যাঁরা সামনের সারিতে ছিলেন, তাঁদের অন্যতম ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র সংসদের এক পদাধিকারী। যিনি এখন একটি নকশালপন্থী গোষ্ঠীর সর্ব ক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী। তাঁর বক্তব্য, ‘‘যাঁরা ছাত্র আন্দোলন করেন, তাঁরা সকলেই সব ছেড়ে মূল ধারার রাজনীতিতে সর্ব ক্ষণের জন্য যুক্ত হবেন, এটা হতে পারে না। একটা মেডিক্যাল কলেজে যদি ৫০০ ডাক্তারি পড়ুয়া থাকেন আর তাঁরা যদি কোনও দাবি নিয়ে আন্দোলন করেন, তা হলে তার মানে কি তাঁদের সকলকে ডাক্তারি ছেড়ে দিয়ে রাজনীতি করতে হবে? এটা হয়?’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘যিনি বাম ছাত্র আন্দোলন করেছেন, তিনি পেশায় যুক্ত হবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পেশায় যুক্ত হওয়ার পরে যদি দেখা যায়, একটা সময়ে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলতেন, আর এখন ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক কথা বলছেন, তা হলে সেই রাজনীতির যথার্থতা থাকে না।’’

২০০৪-’১১ পর্বে যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়ুয়া ছিলেন চিত্রিতা কুন্ডু। ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন তিনি। করতেন অতিবাম ছাত্র সংগঠন পিডিএসএফ। চিত্রিতা এখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে অনেক দূরে। যাদবপুর থেকে মাস্টার্স করার পরে চলে গিয়েছিলেন আইআইটি গুয়াহাটিতে পিএইচডি করতে। এখন চাকরিসূত্রে থাকেন মুম্বই। চিত্রিতা যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সেই সাধারণ সম্পাদক, যিনি র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ইস্তফা দিয়েছিলেন পদ থেকে। তিনি স্পষ্টই বলছেন, ‘‘কলকাতায় না থাকার ফলেই আর সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে থাকতে পারি না।’’ তবে চিত্রিতা মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘‘ছাত্র রাজনীতির সময়টা কিন্তু পড়ুয়া বয়সটাই। তার পরে কেউ ছাত্র রাজনীতি করতে পারে না।’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘পিএইচডিটা খড়্গপুর আইআইটিতে করতে পারলেও এই বিচ্ছিন্নতা থাকত না।’’

চিত্রিতা যেমন কলকাতা থেকে অসমে চলে গিয়েছিলেন, তেমনই আবার অসম থেকে কলকাতার যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে পড়তে এসেছিলেন ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী। ক্যাম্পাসেই ছাত্র আন্দোলনে হাতেখড়ি। ছিলেন সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের নেতা। ধ্রুবজ্যোতি আর অসমে ফেরেননি। পেশাতেও যাননি। হয়েছেন সিপিএমের সর্ব ক্ষণের কর্মী। আপাতত তিনি দলের কলকাতা জেলা কমিটির সদস্য। দলের তাত্ত্বিক মুখপত্রকে আধুনিক করার অন্যতম পুরোধা। তবে আরও একটি পরিচয় রয়েছে ধ্রুবজ্যোতির। তিনি সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘এক্স=প্রেম’ ছবির গান লিখেছেন। সে বাবদে পাওয়া পারিশ্রমিক তুলে দিয়েছিলেন দলের স্থায়ী স্কুলের উন্নতিতে। ২০১৪ সালে ‘হোক কলরব’ আন্দোলনের সময়ে যাঁরা সামনের সারিতে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম এসএফআইয়ের সৈনিক শূর। তিনি এখন সিপিএমের সর্ব ক্ষণের সৈনিক। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁরা ছাত্র রাজনীতি করেন, তাঁরা সকলেই পরে মূলধারার রাজনীতি করবেন, এটা বাস্তবসম্মত নয়। যত ছেলেমেয়ে ছোটবেলায় ভাবে ফুটবলার বা ক্রিকেটার বা আঁকিয়ে হবে, তারা কি সকলেই তা হতে পারে? কিন্তু তা বলে একটা সময়ে তিনি মন দিয়ে যে কাজটা করতেন, তাকে অস্বীকার করা যায় না।’’

যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে ১৯৯৭ সালে পাশ করে বেরিয়েছিলেন পিনাকী মিত্র। করতেন অতিবাম সংগঠন। পরবর্তী কালে নানা সামাজিক আন্দোলনে থেকেছেন। যুক্ত ছিলেন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনেও। আপাতত রয়েছেন সুইডেনে। পিনাকীর কথায়, ‘‘যাঁরা ছাত্র আন্দোলন করেন, তাঁরা পরবর্তী কালে মূল ধারার রাজনীতিতে থাকেন না এটা আংশিক সত্য।’’ তাঁর বক্তব্য, যাঁরা যে কোনও ধারার বাম ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই চেতনায় প্রগতিশীল চিন্তা বহন করে চলেছেন। অর্থাৎ চেতনায় প্রভাব থেকে গিয়েছে।

শমীক চক্রবর্তী যাদবপুরের প্রাক্তনী। তিনি ছাত্র আন্দোলনের পরে বেছে নিয়েছেন সামাজিক আন্দোলনকেই। নেপালি ভাষা শিখে চা বাগানের শ্রমিকদের সংগঠিত করে নানা আন্দোলনে জুড়ে থাকেন শমীক। তিনি বলছেন, ‘‘ছাত্রজীবনে অনেকে কবিতা লেখেন, অনেকে নাটক করেন। তাঁরা কি সারা জীবন সেটাই করেন? এই প্রশ্ন ওঠাটাই অমূলক।’’ বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যাঁরা ভূমিকা নেন, সেটাও এক ধরনের রাজনীতি করাই।

ছাত্র আন্দোলন করে মূল ধারার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে ক্ষমতায় থেকেছেন, এমন উদাহরণ বাংলায় নতুন নয়। বাম-অবাম উভয় ক্ষেত্রেই। বামেদের যেমন সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তী, তেমনই কংগ্রেসের ছাত্র রাজনীতিতে প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি, সুব্রত মুখোপাধ্যায়রা। উল্লেখ্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান ছাত্র আন্দোলন থেকেই। বর্তমান প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকারও ছাত্র আন্দোলনের ফসল। প্রদেশ কংগ্রেসের অন্যতম মুখপাত্র আশুতোষ চট্টোপাধ্যায়ও ছাত্র পরিষদের নেতা ছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘ব্রাত্যবাবুর মাথায় রাখা উচিত, তাঁর নেত্রীও ছাত্র আন্দোলন থেকেই মূল ধারার রাজনীতিতে এসেছেন।’’

অর্থাৎ, যাঁরা ছাত্র রাজনীতি করেন এবং বিপ্লবের স্লোগান দেন, তাঁদের অনেকে সারা জীবন সেই আগুন জ্বালিয়ে রাখেন। কেউ দাউদাউ। কেউ ধিকি-ধিকি। আবার অনেকের আগুন নিভেও যায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement