মোগলমারিতে চলছে সংরক্ষণের কাজ। — নিজস্ব চিত্র।
চোদ্দোশো বছর আগেও এমন বৃষ্টিতে প্লাবন হত। জল আছড়ে পড়ত বিরাট একটি প্রতিষ্ঠানের বড় বড় ভবন, চত্বর, সিঁড়ি, দেওয়ালে। তার ভিতরে নিশ্চিন্তে বর্ষার সময়টুকু কাটাতেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, শিক্ষক, শ্রমণ, বণিক, পর্যটক, সাধারণ মানুষ। কখনও আসতেন রাজাও।
পুরাতত্ত্ববিদেরা চান, এখনকার পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনের কাছে মোগলমারির চোদ্দোশো বছরের পুরনো সেই স্থাপত্য এখনও সে ভাবেই খোলা পড়ে থাক মাটির উপরে। আসুক বৃষ্টি। তার উপরে ছাউনি দেওয়ার কোনও দরকার নেই। বরং পোক্ত করা হোক তার দেওয়াল। তাঁদের মত, বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে স্থাপত্যটি ঢেকে দিলে তার প্রকৃত রূপ নষ্ট হয়ে যাবে। পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে এই স্থাপত্যটি তৈরির সময় ইট গাঁথতে মূলত মাটির সঙ্গে পাটের কুচি, খড় ও গাছের আঠার মিশ্রণ ব্যবহার করা হত। রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব দফতরের পুরাতত্ত্ববিদ প্রকাশচন্দ্র মাইতি বলেন, ‘‘এখন আমরা যে মিশ্রণটি ব্যবহার করছি তার দু’ভাগ চুন, দু’ভাগ সুড়কি আর এক ভাগ বালি। তার সঙ্গে যোগ করা হচ্ছে সামান্য চিটেগুড়।’’ এতেই এই স্থাপত্য বর্ষার ধাক্কা সামলে দিতে পারছে। তবে চাতালের মতো অংশটিতে জল জমতে পারে। তাই সেখান থেকে বৃষ্টির জল বার করে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। দেওয়ালের কিনারায় গোটা ইট ও মাঝখানে ভাঙা ও কুচো ইট ব্যবহার করা হচ্ছে। দেওয়ালগুলো সাধারণত এক থেকে দু-আড়াই মিটার পুরু। উচ্চতা কোথাও কোথাও দু’মিটার।
বেশিরভাগ প্রত্নক্ষেত্রই উৎখননের পরে খোলাই ফেলে রাখা হয়। কিন্তু তাতে জল-বাতাসের সংস্পর্শে এসে সেই স্থাপত্যের ক্ষতিও হয়। যে কারণে, অনেক পুরাতত্ত্ববিদের মত, খননের পরে স্থাপত্য আবার মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়াই ভাল। মাটির নীচে প্রাচীন স্থাপত্য সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু তাতে তা আর কেউ দেখতেই পেতেন না। প্রকাশবাবু বলেন, ‘‘তাই আমরা ঠিক করেছি, প্রাচীন স্থাপত্যগুলির দেওয়াল, ছাদই সংস্কার করতে হবে। যাতে প্রকৃতির সংস্পর্শে এসেও তার ক্ষয় না ঘটে।’’
তিনি জানান, মাটি চাপা থাকার সময় পোড়ামাটির এই স্থাপত্যকর্ম ভিজে মাটি থেকে সোডিয়াম ক্লোরাইড টেনে নেয়। খননের পর মাটি সরে গেলে তাই প্রথম কাজ হচ্ছে ক্ষারহীন জল দিয়ে সেই স্থাপত্যকে ধোয়া। তারপরে ওই ইটের গা থেকে কাগজের মণ্ড দিয়ে সেই সোডিয়াম ক্লোরাইড সযত্নে মুছে তুলে ফেলা হয়। তাতে প্রাচীন দেওয়াল আবার পুরনো শক্তি কিছুটা ফেরত পায়। এরপরে তার গায়ে লাগানো হয় বিশেষ ধরনের একটি রাসায়নিক। তারপরেই চুন-সুড়কি-বালি-চিটে গুড়ের মিশ্রণ দিয়ে আরও মজবুত করা হয় স্থাপত্যটি।
প্রায় এক সহস্রাব্দ মাটির নীচে পড়ে ছিল মোগলমারির স্থাপত্যটি। এখানে উৎখনন করেছিলেন রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের উপ-অধিকর্তা প্রয়াত অমল রায়। তাঁরও মত ছিল, তাম্রলিপ্ত বন্দরের কাছাকাছি বৌদ্ধ ধর্মচর্চার এই কেন্দ্রটি ছিল বিরাট একটি প্রতিষ্ঠান। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, শিক্ষক, ছাত্রেরা ছাড়াও সেখানে যেতেন বণিক, পর্যটকেরাও। তখন নালন্দাও তৈরি হয়নি। সদ্য গুপ্ত যুগ শেষ হয়েছে। নানা জায়গায় ছোট ছোট রাজারা স্বাধীন হয়েছেন। সে সময় পূর্ববঙ্গের আজকের ঢাকা, বিক্রমপুর, মুন্সিগঞ্জ অঞ্চলে দ্বাদশাদিত্য, ধর্মাদিত্য, গ্রহচন্দ্র ও সমাচারদেব নামের চার জন স্থানীয় রাজার নাম পাওয়া যায়। প্রত্যেকেই ষষ্ঠ শতকে রাজত্ব করতেন। এই সমাচারদেবের একটি মিশ্রধাতুর মুদ্রা ও একটি স্বর্ণালঙ্কার পাওয়া গিয়েছে মোগলমারির বিহারটি থেকে। মুদ্রাটিতে গুপ্ত রাজাদের মতোই এক পিঠে ধনুর্বাণ হাতে রাজার প্রতিকৃতি, অন্য দিকে গজলক্ষ্মী। রাজার প্রতিকৃতির পাশেই ব্রাহ্মী অক্ষরে খোদিত তাঁর নাম।
কিন্তু সম্ভবত সেই গৌরব খুব বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি এই প্রতিষ্ঠান। অনুমান করা যায়, নালন্দা, বিক্রমশীলার উত্থানের পরে মোগলমারির অনাদর বাড়তে থাকে। ওই দু’টি বৌদ্ধ বিদ্যাচর্চাকেন্দ্রই আয়তনে মোগলমারির চেয়ে বড়। ভৌগোলিক কারণে কদর কমতে থাকে তাম্রলিপ্ত বন্দরেরও। তাই একটু একটু করে ধুলো-বালির স্তর জমতে থাকে মোগলমারির প্রতিষ্ঠানটির উপরে।
এলাকার মানুষ কিন্তু জানতেন, এখানে কোনও একটি প্রাচীন স্থাপত্য রয়েছে। ইতিহাসবিদরাও খোঁজ পেয়েছিলেন। কিন্তু পুরো দস্তুর পুরাতাত্ত্বিক উৎখনন শুরু হয় ২০০৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন প্রধান প্রয়াত অশোক দত্তের নেতৃত্বে। পরে তা রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের হাতে যায়। এখন স্থানীয় মানুষও এই প্রত্নক্ষেত্র সংরক্ষণে এগিয়ে এসেছেন।