ধামাখালিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানাচ্ছে বিএসএফ। ছবি: নির্মল বসু।
সন্ধে নামলেই বিশেষ কায়দায় হাই টেনশন লাইন বন্ধ করে দিত দুষ্কৃতীরা। অন্ধকারের আড়ালে শ’য়ে শ’য়ে গরু ফসলের খেত মাড়িয়ে সীমান্তের এ দিক থেকে ও দিকে চলে যেত। প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না এলাকার মানুষের।
কিন্তু মাস দু’য়েক হল ছবিটা আমূল বদলে গিয়েছে। গরু পাচার বন্ধ হয়েছে গাইঘাটার আংড়াইল সীমান্ত দিয়ে। বুধবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে কাছে পেয়ে তাঁকে স্মারকলিপি দিয়ে সে সব কথা জানিয়েছেন এলাকার মানুষ। মন্ত্রীর কাছে তাঁদের আবেদন, ‘‘গরু পাচার আমাদের জীবন ওষ্ঠাগত করেছিল। সে সব মাস দু’য়েক ধরে বন্ধ। আমরা শান্তিতে আছি। ওই দিন যেন আর ফিরে না আসে।’’
সব শুনে মন্ত্রীও স্মিত হেসে হাত তুলে বাসিন্দাদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন। পরে সাংবাদিক সম্মেলনে রাজনাথ বললেন, ‘‘এখানে গরু পাচার কমেছে। বাংলাদেশে গরুর মাংসের দামও কমেছে।’’
কিন্তু শুধু কি তাই? উত্তর ২৪ পরগনার সীমান্তবর্তী গ্রাম আংড়াইলের মানুষের অভিজ্ঞতা বলে, গত কয়েক মাসে বিএসএফের নজরদারিও বেড়েছে কয়েক গুণ। বিএসএফের ৪০ নম্বর ব্যাটালিয়নের কোম্পানি কমান্ড্যান্ট প্রদীপকুমার বলেন, ‘‘উপরমহলের নির্দেশ ছিল। আমরাও ব্যবস্থা নিয়েছি।’’ পাশেই দাঁড়ানো গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সভাপতিকে সুব্রত সরকারকে দেখিয়ে প্রদীপকুমার বলেন, ‘‘ওঁরাও অনেক সহযোগিতা করেছেন।’’ সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘আসলে পাচারের প্রধান রুট হিসেবে আংড়াইলের নামটা বারবার উঠে আসছিল। সংবাদমাধ্যমে ধারাবাহিক লেখালেখির পরে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার, বিএসএফ নড়েচড়ে বসে।’’
এর আগে গরু পাচারের সূত্রে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের বাড়বাড়ন্ত দেখেছে আংড়াইল। কয়েক মাস আগে মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মল ঘোষ নামে আংড়াইলের বাসিন্দা এক আরপিএফ জওয়ানকে কুপিয়ে খুনও করে এক দল দুষ্কৃতী। প্রতিবাদে দীর্ঘ আন্দোলন চালিয়েছিলেন স্থানীয় মানুষ। তারপরেও দুষ্কৃতীদের দাপাদাপি বন্ধ করা যায়নি।
এ দিন নির্মলবাবুর স্ত্রী বর্ণালীর সঙ্গে দেখা করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। নিহতের স্ত্রী পরে বলেন, ‘‘বহু বার বিচার চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। কিন্তু অপরাধীরা এখনও কেউ ধরা পড়েনি। মন্ত্রী এ দিন আশ্বস্ত করায় শান্তি পেলাম।’’
যে পথ দিয়ে এত দিন গরু যাতায়াত করত, সেই ইছামতীর পাড় এ দিন ঘুরে দেখেন রাজনাথ। সঙ্গে ছিলেন বিএসএফ কর্তারা। পরে এলাকার মানুষ তাঁকে লিখিত স্মারকলিপি দেন। আংড়াইল ও ইছামতী নদীর ও পাড়ে বাংলাদেশের যশোরের পুঁটখালি এলাকায় সমস্ত গরুর খাটালগুলি ভেঙেচুরে পড়ে থাকতে দেখেন মন্ত্রী।
কিন্তু এত দিন ধরে গরু পারাপারের জন্য শুরু হয়েছে নদীপাড়ের ভাঙন। বিশ্বাসপাড়া, যেখান দিয়ে এত দিন গরু পাচার হত, এ দিন সেখানে গিয়ে মন্ত্রী ভাঙন নিজের চোখেই দেখেন। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ‘‘এই রাস্তা ঠিক করে দিন। নদী ভাঙন ঠেকানোর ব্যবস্থা করুন।’’ বিষয়টি দেখার আশ্বাস দিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী।
আংড়াইলে জলপথে এলাকা ঘুরে দেখছেন রাজনাথ সিংহ। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গরু পাচার বন্ধ হওয়ায় গত দু’মাসে রীতিমতো বদল এসেছে জনজীবনে। একটা সময়ে এলাকার বহু মানুষও জড়িয়ে পড়েছিলেন অবৈধ এই ব্যবসায়। হাতে কাঁচা টাকা আসত সহজেই। এক একেকটা গরু সীমান্তের ও পারে চালান করে দিতে পারলেই হাতে হাতে মিলত টাকা। ফলে পঞ্চায়েতে একশো দিনের কাজে লোক পেতে সমস্যা হত। চাষবাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বহু জমিতে। গরুর পায়ের চাপে ফসল নষ্ট হওয়া ছিল এই এলাকার মানুষের ফি বছরের দুর্গতি। অনেকে এলাকা ছেড়ে পাত্তাড়ি গুটিয়েছিলেন।
এখন অবশ্য গরু পাচারে লাইনম্যানের কাজ ছেড়ে রাজমিস্ত্রির কাজ ধরেছেন সুভাষ বিশ্বাস, বরেণ মণ্ডলদের মতো অনেকে। জানা গেল, যে মোটরবাইকে এলাকা পাহারা দেওয়া দিত ছেলেছোকরারা, সেই মোটরবাইক বিক্রি করে দিচ্ছে অনেকে। সস্তায় বিকোচ্ছে সেই মোটর বাইক। হাসি ফুটেছে মন্মথ বিশ্বাসের মতো চাষিদের মুখে। তিনি নিজের জমিতে ফের পটল, পেঁপে, লঙ্কা লাগিয়েছেন। তবে গরু পাচার বন্ধ হলেও ধুর (মানুষ) পাচার যে একেবারে কমেনি, সে কথাও মন্ত্রীকে জানিয়েছেন স্থানীয় মানুষ। স্থানীয় চিকিৎসক দুলাল সরকার জানালেন, ‘‘মাস কয়েক আগেও এলাকার পরিস্থিতি কতটা যে ভয়ঙ্কর ছিল তা বলে বোঝানো যাবে না। সন্ধের পরে ঘরের বাইরে যাওয়ার জো ছিল না। ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারিদিকে চিৎকার, হইচই। পাচারকারীদের সামনে মুখ খোলার সাহস পেত না কেউ।’’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘুরে যাওয়ার পরেও পরিস্থিতি তেমনই থাকবে কিনা, সেই চিন্তাতেই রয়েছেন মানুষ।