বিদায়: প্রয়াত কৃষ্ণা বসুকে শ্রদ্ধা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুগত বসু এবং সুমন্ত্র বসুর। শনিবার নেতাজি ভবনে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
এ মাসের গোড়ায় স্বামী শিশিরকুমার বসুর শতবর্ষ অনুষ্ঠানের কাজে পুরোভাগে ছিলেন তিনি। সপ্তাহখানেক আগে পর্যন্ত নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর কাজেও মগ্ন ছিলেন কৃষ্ণা বসু। গত বছরের শেষে তাঁর ৮৯ বছর পূর্ণ হওয়ার ঠিক আগে চোখের অস্ত্রোপচারের পরে যেন নতুন উদ্যম ফিরে পেয়েছিলেন জীবনে।
নতুন করে নানা পড়াশোনায় ডুবে আছেন। লেখালেখির কথা ভাবছেন। সেই তিনি শনিবার সকালে প্রয়াত হলেন। এ দিন বেলা ১০টা ২০ মিনিট নাগাদ মুকুন্দপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে কৃষ্ণা বসুর জীবনাবসান হয়েছে। সপ্তাহখানেক আগে অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয় কৃষ্ণাকে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সেরিব্রাল স্ট্রোকের পরে অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয় বলে হাসপাতাল সূত্রের খবর। সন্ধ্যায় সরকারি গান স্যালুটের মধ্যে কেওড়াতলা শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য হয়েছে। যাদবপুরের তিন বারের তৃণমূল সাংসদ, শিক্ষাবিদ, সুলেখক কৃষ্ণার দুই ছেলে সুগত বসু, সুমন্ত্র বসু এবং কন্যা শর্মিলা রয়েছেন।
সুভাষচন্দ্র বসুর ভাইপো বৌ, সুভাষের দাদা শরৎকুমার বসুর বৌমা কৃষ্ণার দীর্ঘ জীবনে গুণিজন সান্নিধ্যের অভিজ্ঞতা দুর্লভ। জীবনের উপান্তে পৌঁছেও সব মনে রেখে সুষম কাটাছেঁড়ায় সুসংবদ্ধ সরস গদ্য লিখতেন কৃষ্ণা। ডিসেম্বরে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নিয়ে দেশ উত্তাল হয়ে উঠলে দেশভাগ-দাঙ্গার রক্তাক্ত স্মৃতি থেকেই শিক্ষা নেওয়ার কথা বলতেন তিনি। অবিভক্ত ভারতে মামার বাড়িতে ঢাকায় জন্ম কৃষ্ণার। সিএএ-এনআরসি প্রসঙ্গে কিছুটা পরিহাসচ্ছলে বলতেনও, ওরা কি আমাকেও ফেরত পাঠাতে চাইবে!
আরও পড়ুন: শ্রীকৃষ্ণা বসু (১৯৩০-২০২০)
কৃষ্ণা ও শিশির বসুর বড় ছেলে ইতিহাসবিদ ও প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ সুগত বসু এ দিন বলছিলেন, ‘‘মা স্বাধীনতার আগে সোদপুরে গাঁধীকে দেখেছেন। আজাদ হিন্দ ফৌজে নেতাজির সহযোদ্ধাদের কাছে খুঁটিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা শুনেছেন, লিপিবদ্ধ করেছেন।’’ ৪০ বছর ধরে সিটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেছেন। কলেজের অধ্যক্ষাও হয়েছিলেন। কৃষ্ণার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে, ‘ইতিহাসের সন্ধানে’, ‘অ্যান আউটসাইডার ইন পলিটিক্স’, ‘এমিলি অ্যান্ড সুভাষ’ ইত্যাদি। হার্ভার্ডে পুত্র সুগত, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সে অধ্যাপনারত পুত্র সুমন্ত্রের কাছে গত বছরের শেষেও অনেকটা সময় কাটিয়েছেন কৃষ্ণা। এ দিন শান্তিনিকেতনে অমর্ত্য সেনও হার্ভার্ডে কৃষ্ণাদেবীর মূল্যবান সাহচর্য লাভের কথা বলেছেন। ‘‘আমি ভাগ্যবান, ওঁর স্নেহ, বন্ধুত্ব লাভের সুযোগ পেয়েছি!’’— বলেন অমর্ত্য। সাংসদ কৃষ্ণার ভূমিকা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘‘ওঁর (কৃষ্ণা) মতো মানুষ পাওয়া ভারতবর্ষের পক্ষে খুবই ভাগ্যের ছিল। ভারত বা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ক্ষেত্রে ওঁর নানা কথায় আমরা উপকৃত হয়েছি।’’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখেও ‘‘কৃষ্ণাদি তৃণমূল পরিবারের মা।’’ মমতা বলেন, ‘‘নেতাজি রিসার্চ বুরোর প্রধান হিসেবে নেতাজির আদর্শ ও দেশপ্রেমের ভাবনাকে কৃষ্ণাদি প্রসারিত করে গিয়েছেন। রাজনীতি-শিক্ষার জগতে অপূরণীয় ক্ষতি হল।’’ এ দিন হাসপাতাল থেকে বাড়িতে এনে কিছু ক্ষণ রাখার পরে নেতাজি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয় কৃষ্ণার দেহ। সেখানেও রাখা হয় কিছু ক্ষণ। কৃষ্ণার বাড়িতে গিয়ে শোক জানান রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়।
দলমত নির্বিশেষে কৃষ্ণার অবদান নিয়ে সব দলই মুখর। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুর কথায়, ‘‘উনি রাজনীতিতে অংশ নিলেও আমার সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ হয়নি।’’ ‘‘নেতাজি পরিবারের একজন কৃষ্ণা বসু নিজের বিচারবোধ ও চিন্তার গভীরতায় ভাস্বর ছিলেন’’, বলে মন্তব্য করেন সংসদে কংগ্রেসের দলনেতা অধীররঞ্জন চৌধুরী। বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষও শিক্ষাবিদ-সাংসদ কৃষ্ণাদেবীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান স্মরণ করেছেন।