বাড়িতে ফেরার পরে শেলি বাগ। স্মৃতিভ্রংশ হলেও ছবি বিশ্বাসের (ডান দিকে) নামটুকু আঁকড়েই বাড়ি ফিরেছেন তিনি। নিজস্ব চিত্র, ফাইল চিত্র।
নিজের নাম মনে নেই। সন্তানদের নামও মনে নেই। ঠিকানাও মুছে গিয়েছে স্মৃতি থেকে। শুধু মনে থেকে গিয়েছে ছবি বিশ্বাসের নাম। সেই নামটুকুকে আঁকড়ে ধরেই শেষ পর্যন্ত পরিবারের কাছে ফিরে এলেন আশি ছুঁইছুঁই এক বৃদ্ধা।
বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ ছবি বিশ্বাসের নামে এক সময়ে সিনেমা থেকে থিয়েটারের প্রেক্ষাগৃহে ভিড় করতেন যে দর্শকেরা, তাঁদের মধ্যে হয়তো থাকতেন বারাসতের ছোট জাগুলিয়ার বাসিন্দা শেলি বাগও। তবে নিছক অনুরাগীর পরিচয় ছাপিয়ে শেলিদেবীর পরিবার নিজেদের ‘ছবিবাবুর প্রতিবেশী’ ভাবতেই ভালবাসে। কারণ, বৃদ্ধা শেলিদেবীর বাড়ির অদূরেই তো ছবিবাবুর পৈতৃক বাড়ি! অবশ্য এখন সেখানে ছবিবাবুর উত্তরপুরুষেরা কেউ থাকেন না। কিন্তু পুরনো স্থাপত্যরীতিতে তৈরি সেই বাড়ির দৌলতেই ‘জলসাঘরের বিশ্বম্ভর রায়’ এখনও জীবন্ত এই পাড়ায়। এই বাড়ি দেখতেই আজও ছুটে আসে লোকজন। স্মৃতিভ্রংশে আক্রান্ত শেলিদেবী বেলেঘাটা থানার পুলিশের হাতে উদ্ধার হওয়ার পরে তাঁর স্বনামধন্য ‘প্রতিবেশী’র নাম বলতে পেরেছিলেন বলেই সোমবার রাতে ছোট জাগুলিয়ার নতুন পুকুরে নিজের বাড়িতে ফিরতে পেরেছেন।
অবশ্য এর পিছনে রয়েছে হ্যাম রেডিয়োর সদস্যদের তৎপরতাও। পশ্চিমবঙ্গ রেডিয়ো ক্লাবের সম্পাদক অম্বরীশ নাগবিশ্বাস জানান, ঠান্ডার মধ্যে বৃদ্ধাকে রাস্তায় ঘুরতে দেখে বেলেঘাটা থানার পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে। বৃদ্ধা নাম-পরিচয় কিছুই জানাতে পারেননি। পুলিশ তাঁকে সরকারি হোমে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে হ্যামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
অম্বরীশের কথায়, ‘‘হোম বৃদ্ধার সঙ্গে আমাদের টেলিফোনে কথা বলায়। নাম-ঠিকানা জানতে চাইলে বৃদ্ধা শুধু ‘ছবি বিশ্বাস’ বলছিলেন। প্রথমে আমরাও তা-ই (বৃদ্ধার নামই ছবি) ভাবছিলাম। কারণ ‘ছবি’ নাম মহিলাদেরও হয়। কিন্তু তাতে তো ঠিকানা বার করা যাচ্ছিল না। বৃদ্ধার সঙ্গে দু’-এক দিন কথা বলে আলাপ জমাতে শেষ পর্যন্ত উনি বলেন, বারাসতে ছবি বিশ্বাসের বাড়ির কাছে উনি থাকেন। তার পরেই আমাদের সদস্যেরা শেলিদেবীর পরিবারকে খুঁজে বার করেন।’’
বারাসত ১ নম্বর ব্লকে যে ছবি বিশ্বাসের স্মৃতি রয়েছে, সেটা স্থানীয় অনেকেই জানেন। ১৯৬২ সালের ১১ জুন নিজে গাড়ি চালিয়ে ছোট জাগুলিয়ায় যাওয়ার পথেই মধ্যমগ্রামের কাছে গঙ্গানগরে এক দুর্ঘটনায় ছবিবাবুর মৃত্যু হয়। তাই ওই সব এলাকার পুরনো বাসিন্দাদের কেউ কেউ ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে একটু বেশি রকমই স্মৃতিমেদুর। শেলিদেবীর ঘটনা শুনে তাঁরা অনেকেই অবাক।
বৃদ্ধার পরিবার জানাচ্ছে, আগেও কয়েক বার তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। কখনও অন্য লোকেরা তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছেন বাড়িতে। কখনও আবার পরিবারের লোকজনই গিয়ে খুঁজে এনেছেন। পুত্রবধূ স্বপ্না বাগের কথায়, ‘‘এর আগেও এক বার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে নিউ ব্যারাকপুর থানা শাশুড়িকে উদ্ধার করেছিল। সে বারেও ছবি বিশ্বাসের নাম আর বারাসতের বাসিন্দা— এইটুকুই উনি পুলিশকে বলতে পেরেছিলেন। তার পরে পুলিশ শাশুড়িকে ফেরত দিয়ে যায়। এ বারে কাউকে না বলে উনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সোমবার রাতে ফেরত এসেছেন। ওঁর চিকিৎসাও চলছে।’’
বারাসত ১ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি গিয়াসুদ্দিন মণ্ডল বলেন, ‘‘এখানে বিশেষত পুরনো বাসিন্দাদের মধ্যে ছবিবাবুর জনপ্রিয়তা রয়েছে। ওঁর বাড়িটি দেখতে লোকজন আসেন। বাড়িটির বয়স অন্তত ১০০ বছর তো হবেই। সোমবার রাতে মহকুমাশাসকের ফোন পেয়ে আমি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিকে ফোন করি। উনি শেলিদেবীর প্রতিবেশী। তার পরেই সবটা জানতে পারা যায়।’’
ছবি বিশ্বাসের অমর সংলাপ ছিল ‘সবার উপরে’ ছবিতে, ‘‘ফিরিয়ে দাও আমার সেই বারোটা বচ্ছর...।’’ শেলিদেবীর মন থেকে তাঁরই জীবনের ফেলে আসা বছরগুলোর স্মৃতি
মুছে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে। কিন্তু রয়ে গিয়েছেন স্বয়ং ছবি বিশ্বাস— তাঁর স্বনামধন্য প্রতিবেশী।