কখনও গোল, কখনও কাস্তে, কখনও ‘ঝলসানো রুটি’র খানিকটা ছিঁড়ে খাওয়া মতো! কখনও নিজেকে সোনার আলোয় মুড়ে রাখে, কখনও ঝকঝকে রৌপ্যকান্তি! চাঁদ সত্যি ভারী আশ্চর্যের! আকর্ষণীয়, বিচিত্ররূপ!
আমাদের বাংলায় চাঁদ নিয়ে যত ছড়া, কবিতা, গান, বিবরণ, তুলনা ও বাগ্ধারা আছে, তার বেশির ভাগই সৌন্দর্য ও সকরুণ পেলব অনুভূতির দ্যোতক। শুধু চন্দ্রলুপ্তি হলে ভারী দুঃখ আর চন্দ্রাহত হলে উদ্বেগের বিষয়। চন্দ্রদোষে নেকড়ে ও সারমেয়কুলও নাকি করুণ সুরে ডাকডাকি করে, যাকে গানের মতোই শোনায়। মনে রাখা ভাল, অর্ধচন্দ্রপ্রাপ্তিও সুখের বিষয় নয়।
চাঁদের সঙ্গে শরীরের বাতবেদনার সংযোগ আছে বলে অনেকে মনে করেন। পূর্ণিমা-অমাবস্যায় নদী-সমুদ্রে জোয়ার-ভাটির উত্তাল তরঙ্গপ্রবাহের মতো ব্যথাস্রোতেও নিদারুণ উথলিত হয়। আবার বহু মানুষের বিশ্বাস চাঁদ ও মানবমন সম্পর্কিত। চান্দ্র দুর্বলতার পরিণাম পাগলামি। ইংরেজিতে তো বলাই হয় ‘লুনাটিক’! কিন্তু বৈজ্ঞানিকগণ এই সংযোগ ও প্রভাব বাতুলতা বলেই মনে করেন।
আসলে, চাঁদ আমাদের বড় চেনা। বড়ই আপনজন। ওই রহস্যময় বিশাল মহাকাশে চন্দ্র-সূর্যকেই আমরা কাছে পাই। সূর্যের সৌন্দর্য আমাদের মোহিত করে ঠিকই। কিন্তু তার সুবিপুল শক্তির সামান্য আভাসও আমাদের জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। তার তুলনায় চাঁদ এমনই স্নিগ্ধ যে, তাকে ঘিরে নিশ্চিত আবেগে, কল্পনায় ডুবে থাকতে অসুবিধে নেই।
এ বিশ্বে যে পাঁচটি বিষয়ের প্রতি আমার অমোঘ আকর্ষণ, তার একটি চাঁদ। এর কারণ সম্ভবত এই যে, আরও সব ভারতীয় শিশুর মতো আমিও ‘চাঁদের কপালে চাঁদ টি দিয়ে যা’ শুনে আপ্লুত হয়েছি। আমাদের কালচিনি চা-বাগানের বাবুবাসার আঙিনায় মায়ের কোলে দাঁড়িয়ে ‘আয় আয় চাঁদমামা’ বলে ডেকেছিও কত!
চাঁদ সত্যি আমার মামা কি না, এ নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত ছিলাম না। মা কবে তাকে ভাই বলে ডাকলেন, তা-ও জানতে চাইনি। কিন্তু উঠোনে ঠায় দাঁড়িয়ে চন্দ্রদর্শন এবং তাতে চড়কা-কাটা বুড়ি অবলোকন করাই দীর্ঘকাল আমার মূল আকর্ষণ ছিল। শুধু আমিই-বা বলি কেন, আমার বন্ধুরাও সেই বুড়ির কাটা একগাছি সুতো পাওয়ার জন্য ব্যাকুল ছিল। শুক্রবার গুদরি বাজারে যে মিষ্টির তুলো বিক্রি হত, কে যেন বলেছিল, ওই হল বুড়ির সুতো। বিশ্বাস করতে কী ভালই না লাগত!
চাঁদের উপর আরোপিত মাতুল সত্তা আমি একদিন ছুড়ে ফেলে দিলাম। তখন আমার বয়স ঠিক এগারো। ঠিক কোন কাল থেকে প্রতিটি ঋতু আমি পৃথক ভাবে অনুভব করতে শিখেছি, মনে নেই। তবে ঠিক ওই বয়সে, এক বিশেষ দিনে, সোনায় মোড়া পূর্ণচন্দ্র, এক স্বর্ণেন্দু, সম্পূর্ণ নতুন রূপে আমার হৃদয়াসনে বসে আদেশ করেছিলেন— অপলক দেখো। চিরকাল দেখো। অনিমেষ। নেই শেষ, এর নেই শেষ।
কোজাগরী পূর্ণিমার পড়ে আসা বিকেল সন্ধ্যায় মিলিত হয়-হয় সময় মা আবিষ্কার করলেন, তাঁর লক্ষ্মীপূজার আয়োজনে ধানগাছের গুচ্ছ নেই। দাদা সাইকেল নিয়ে চলল ধানখেত থেকে তুলে আনবে একমুঠো। আমি সামনের রডে বসে। বেশি দূর নয়। দেড় কিলোমিটার। আমাদের ইউনিয়ন অ্যাকাডেমি স্কুলের পিছনে বিশাল ধানের খেত। ফসল ফলাতে ফলাতে কোথায় কত দূরে লতাবাড়ি বা গুদামডাবারি অরণ্যে মিশে গিয়েছে। রেললাইনের ধার বরাবর মূল সড়কে না গিয়ে পথ সংক্ষেপ করার জন্য, না কি তার নিজেরও ওই সন্ধ্যায় চা-বাগানের বনসদৃশ রূপ-গন্ধ ভাল লাগে বলে, চা-বাগান মধ্যবর্তী পথ নিল দাদা। আমরা দক্ষিণ-পশ্চিমে চলতে লাগলাম। চা-বাগানের ঝোপে আঁধার নামছে। জোনাক জ্বলা শুরু হচ্ছে, যেমন আমি জানি, বাবুবাসায় সবার দুয়ারে দুয়ারে জ্বলে উঠছে প্রদীপ-মোমবাতি, ফানুস ওড়াবার আয়োজন চলছে চৌপথিতে।
খেত থেকে ধানের সশীষ গাছের একটি গোছা আমার হাতে ধরিয়ে দাদা ফেরার পথ নিল। সূর্যাস্ত হয়ে যাওয়ার পরেও যে একচিলতে রাঙা আভা পৃথিবীর গায়ে লেগে থাকে, সেই রং আমার রোজকারের চেনা। কিন্তু সেদিন চা-বনের গায়ে এক অপার্থিব সোনালি আলো। এখন ফিরতি পথে আমরা উত্তর-পুবে। আর গাছপালার ফাঁকে মুখ তুলেছে, একটু একটু করে মুখ তুলছে আগুনে তাতানো সোনার থালার মতো চাঁদ! আমার শরীর রোমাঞ্চিত হল। মনে হল, এ কী! এ কী! দাদা বলল, ‘দেখছিস চাঁদটা?’ আমার উত্তরের আগেই কেন জানি না হা-হা করে হেসে উঠল সে। ধীরে, অতি ধীরে, যেন জীবনের সব আকাঙ্ক্ষার অবসান হয়ে গিয়েছে তার, এমনই অচঞ্চলতায় এঁকেবেঁকে সাইকেল চালাতে লাগল সে আর গলা ছেড়ে গাইতে লাগল— ও-ও-ও চাঁদ, সামলে রাখো জোছনাকে!
মনে হল, তার চাঁদ আসলে একটা মেয়ে, তার ধীরতা আসলে এক অধীরতা। কখন আমি তাকে ভুলে গিয়ে চন্দ্রে বিমোহিত হলাম। আমার অজ্ঞাতে চাঁদ এক সুপুরুষ মূর্তিতে আমার মনোসিংহাসনে এসে বসলেন। পরবর্তী সময়ে উড়ন্ত ফানুসের অনুসরণে ছুটতে ছুটতে আমরা বন্ধুরা কখনও হাসপাতালের পিছনে ধোপাবাড়ির সামনেকার ডেউয়া গাছের তলায়, কখনও শিরীষ পাতার আস্তরণে ঢাকা মাঠের প্রান্তে কতবার স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি কোজাগরীর চাঁদ! ফানুস নিজের মতো উড়ে গিয়েছে। আমরা একই সঙ্গে চন্দ্রদর্শনের পুলক ও অকারণ বিষাদ নিয়ে ধীর পায়ে ঘরে ফিরেছি। তখন বিপুল শক্তি নিয়ে বসন্ত আসছিল। আমরা জানতাম না। আমাদের শরীরে-মনে আমাদের অগোচরে ঘটে যাচ্ছিল পলাশের নিঃশব্দ উৎসব, আমরা টের পাইনি। বসন্ত মানে তখনও কেবল সরস্বতী পূজা, দোল, হোলিকা দহন।
দোলপূর্ণিমার আগের বিকেলে রাজ্যের খড়কুটো জুটিয়ে দাউ দাউ হোলিকা দহন সেরে, তার মধ্যে দেওয়া আলু, বেগুন, মিষ্টি আলুর দগ্ধ অবশেষ খুঁজে খাওয়া-দাওয়ার পর গোল হয়ে বসে থাকতাম আরও একটু অন্ধকারের অপেক্ষায়। আমরা জানতাম, চা-কারখানার ছাউনির মাথায় চাঁদ উঠবে। আগুনে পোড়া তপ্তকাঞ্চন বর্ণ চাঁদ। যাকে কেউ কল্পনা করে নারী বলে, কেউ পুরুষ বলে। সে একদা চড়কা কাটা বুড়ির সরলতা ও মাতুল সম্বন্ধে টিপ দেওয়ার কাজে ব্যাপৃত ছিল, যে সমস্ত নিয়ম ভেঙে জানিয়ে দেয়, আসলে সকলই বস্তু ও আলোছায়ার খেলা। তবু ওই মায়াবী আলোকময়তা কাউকে কাউকে মুগ্ধ করে রাখে আজীবন!
কত জায়গায় কত রকম চাঁদ দেখেছি, তবু দেখা ফুরোয় না! যে পাঁচ আকর্ষণের অপর এক রবীন্দ্রনাথ, দুই গান, সেই অমোঘ সম্বন্ধে, তাঁর গানে গানে খুঁজে চলেছি চাঁদের বহু বিচিত্র প্রয়োগ, অপর টান যে গাছে-গাছে, জঙ্গল-অরণ্যে— তার ভিতর থেকে চাঁদের রূপ দেখে ধন্য হয়েছি কতবার।
বৃহস্পতির স্ত্রী তারার প্রণয়ী চন্দ্র। আমার মনে হয়, আমিও বুঝি তারা। এই যুগের। এই জন্মের। তাই, আমার আর এক আকর্ষণ— আমার সাহিত্য, কবিতা জুড়ে আছে চাঁদ। অবচেতনে বসে সে কত পঙ্ক্তি লিখিয়ে নেয় নিজের নামে। উপন্যাসের নাম দেয় ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ’, ‘চাঁদু’। গল্পের নাম দেয় ‘রুপোর থালা চাঁদ’, ‘চন্দ্রাভিগ’। এমনকি, ‘চাঁদু’ উপন্যাসের মৎপ্রদত্ত নাম ছিল ‘বোকাচাঁদ’! সম্পাদকের হাতে তা ‘চাঁদু’ হয়ে ওঠে। এতই চাঁদ আমার লেখাপত্রে!
হয়তো আরও আছে। হয়তো আরও আসবে। বার বার। আমি যে নিজেই চন্দ্রাবতী।