রাজ্যে বিজেপির জয়ের নেপথ্যে অন্যতম অস্ত্র অমিত শাহের ‘উত্তরপ্রদেশ মডেল’। বলছেন, রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। তাঁদের দাবি, ‘সফল’ এই মডেলেই বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে দল।
কী সেই মডেল? ২০১৩ সালের জুন মাসে বিজেপির বর্তমান সর্বভারতীয় সভাপতি শাহের হাতে উত্তরপ্রদেশের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল বিজেপি। দেশ জুড়ে বিজেপির গ্রাফ যেমন তখন নিম্নগামী, শাহের রাজনৈতিক কেরিয়ারও তাই। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, সেই সময় উত্তরপ্রদেশের জন্য একটি ত্রিফলা মডেল তৈরি করেছিলেন শাহ। এক, গ্রামে গ্রামে বিস্তারক (প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী) ছড়িয়ে দেওয়া। যাঁরা বুথে বুথে ঘুরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে সমস্যাগুলি বোঝার চেষ্টা করবেন। এবং বুথ স্তর থেকে স্থানীয় নেতা তৈরি করবেন। স্থানীয় স্তরে শাসক দলের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে বিক্ষুব্ধ অংশকে চিহ্নিত করে বিজেপিতে তাদের গুরুত্ব বোঝাবেন। দুই, সঙ্ঘ পরিবারের বিভিন্ন সংগঠনগুলির সঙ্গে দলের সমন্বয় তৈরি করে তাদেরকে পরোক্ষে রাজনীতির কাজে ব্যবহার করা। অর্থাৎ, বুথ স্তর পর্যন্ত রাজনৈতিক কর্মীদের যে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, তাঁরা সত্যিই তা পালন করছেন কি না, তার নজরদারি চালাবেন সঙ্ঘের সদস্যরা। এবং তিন, কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের রাজ্যে নিয়ে এসে লাগাতার প্রচার চালিয়ে যাওয়া। যাতে জনমানসে বিজেপি নিয়ে আলোচনা বন্ধ না হয়।
রাজ্য বিজেপির সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চট্টোপাধ্যায় মানছেন, বছর দু’য়েক ধরে ঠিক এই মডেলেই বাংলায় সংগঠন তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন শাহ। সুব্রতবাবুর কথায়, ‘‘দিলীপ ঘোষ রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পরে এমনিই বৃহত্তর সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে বিজেপির সমন্বয় জোরদার হয়েছিল। নির্বাচনে সেই সমন্বয় অবশ্যই কাজে লেগেছে। পাশাপাশি সর্বভারতীয় সভাপতির তৈরি মডেলে গ্রামে গ্রামে দলের সংগঠনও মজবুত হয়েছে।’’
সূত্রের খবর, লোকসভা নির্বাচনের বছর দু’য়েক আগেই বাংলার গ্রামে গ্রামে প্রথমে ৩৬ জন বিস্তারককে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে ৪২টি কেন্দ্রেই পাঠানো হয় তাঁদের। শাসক দলের তৃণমূল স্তরের ‘বিক্ষুব্ধ’ কর্মীদের চিহ্নিত করে রাজ্য নেতাদের কাছে রিপোর্ট দিতে থাকেন তাঁরা। পাশাপাশি শাসক দলের উপর তলার নেতাদের সঙ্গেও গোপনে যোগাযোগ শুরু হয়। তবে সব চেয়ে জোর দেওয়া হয় সঙ্ঘ পরিবারের অন্য সংগঠনগুলির সঙ্গে সমন্বয়ে। বিজেপির একটি অংশের দাবি, সঙ্ঘের সংগঠন যেখানে যেখানে মজবুত, বিজেপি সে সমস্ত অঞ্চলেই ভাল ফল করেছে।
আরএসএস-এর এক উচ্চপদস্থ প্রচারকের দাবি, গত পাঁচ বছরে রাজ্যে শুধু শাখার সংখ্যাই দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন তার সংখ্যা প্রায় ১৫০০। বেড়েছে সঙ্ঘ পরিচালিত স্কুল এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। এরা কেউই সরাসরি রাজনীতির কথা বলেন না। তাঁরা এক দিকে যেমন সামাজিক স্তরে ‘হিন্দুত্বে’র প্রচার করে মেরুকরণের আবহ তৈরি করেছেন, অন্য দিকে বিজেপির দলীয় কর্মীদের কাজের নিরন্তর মূল্যায়ন করেছেন।
দলের এক কেন্দ্রীয় নেতার বক্তব্য, প্রার্থী নির্বাচনের সময় বার বার সমীক্ষা রিপোর্টের কথা বলেছেন শাহ। যা নিয়ে দলের অন্দরে বিস্তর বিতর্কও হয়েছে। ওই নেতার মতে, শাহের ওই সমীক্ষার অনেকটাই দাঁড়িয়ে সঙ্ঘ এবং দলের সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সম্মিলিত রিপোর্টের ভিত্তিতে। যে কারণে বহু জায়গাতেই রাজ্য নেতাদের কাছে যথেষ্ট অপরিচিত প্রার্থীও টিকিট পেয়ে গিয়েছেন। জায়গার নাম ধরে ধরে শাহ বলে দিয়েছেন কোথায় দলের জেতার সম্ভাবনা বেশি, কোথায় কম। রাজ্য নেতাদের অনেকেই তাঁর সেই ব্যাখ্যার সঙ্গে গোড়ায় দ্বিমত পোষণ করলেও ফলাফলে দেখা গিয়েছে শাহের কথাই ফলে গিয়েছে। আরামবাগের মতো আসনে দলীয় প্রার্থী জয়ের চৌকাঠ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে, যা স্বপ্নেও কখনও ভাবেননি রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ।
যদিও রাজ্যের এক শীর্ষ নেতার কথায়, লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ফলে যে যতই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করুন, শাহ খুশি নন। কারণ রিপোর্টের ভিত্তিতেই ২৩টি আসনের কথা বলেছিলেন তিনি। আসলে এটাও এক ধরনের রাজনৈতিক কৌশল, যাতে সন্তুষ্টির মনোভাব দানা না বাঁধে।