শহিদ মিনারের জনসভায় অমিত শাহ। নিজস্ব চিত্র
দিন কয়েক আগে একটা টিজার লঞ্চ করেছিল পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি। নিছক রুটিন জনসংযোগে যে অমিত শাহ আসছেন না, আসছেন অনেক বড় কোনও লক্ষ্য নিয়ে— বেশ বুঝিয়ে দিয়েছিল সে টিজারই। রবিবার শহিদ মিনার ময়দানে আধ ঘণ্টার ভাষণে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলেন, বাংলায় তাঁর কাছে এখন পাখির চোখ শুধুমাত্র ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন। আর সেই পাখির চোখকে বিঁধে ফেলার জন্য কোন কোন হাতিয়ার ব্যবহার করতে হবে, কী ভাবে করতে হবে, তা-ও স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন কর্মী-সমর্থকদের। ভাষণের শেষ দিকে তৃণমূলের নাম করেই শাহের স্পষ্ট হুঁশিয়ারি, ‘‘আমরা কাউকে ছাড়ব না।’’
‘আর নয় অন্যায়’— স্লোগানটা গত কয়েক দিন ধরেই তোলা শুরু করেছিল বিজেপি। ৬ থেকে ৮ সেকেন্ডের ছোট ছোট ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল টিজারের ঢঙে। ১ মার্চ থেকে অর্থাৎ কলকাতায় অমিত শাহের জনসভার দিন থেকে পশ্চিমবঙ্গে ‘অন্যায়মুক্তি অভিযান’ শুরু হতে চলেছে— এই রকমই বার্তা ছিল সে সব টিজারে। কোন ‘অন্যায়’-এর কথা বলা হচ্ছে, তা ছিল উহ্য। টিজারে যেমন হয়ে থাকে। উহ্য কথাগুলো এ দিন অমিত শাহ স্পষ্ট করে দিয়ে গেলেন। শহিদ মিনারের মঞ্চ থেকে এ দিন তিনি বললেন, ‘‘আর নয় অন্যায়। বন্ধুরা, এই স্লোগান পশ্চিমবঙ্গে সরকার পাল্টানোর স্লোগান।’’
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পরেও অমিত শাহ কলকাতায় এসেছেন। গত অক্টোবরে এসেছিলেন, নেতাজি ইনডোরে সভা করেছিলেন সে বার। প্রকাশ্য সমাবেশ নয়, কর্মী সম্মেলন গোছের।
মঞ্চে উপস্থিত দলীয় নেতাদের সঙ্গে অমিত শাহ। নিজস্ব চিত্র
আরও পড়ুন: ‘লাজের’ সেই তাজমহলই কিনা ট্রাম্পের হাতে তুলে দিতে হল যোগীকে
অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে দেশ থেকে তাড়ানো হবেই, তার জন্য এনআরসি হবে, তবে তার আগে সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ করিয়ে শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে— ইনডোরের সভায় মূলত এই কথাই অমিত শাহ শুনিয়ে গিয়েছিলেন অক্টোবরে। কথা মতো ডিসেম্বরে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশও হয়ে গিয়েছে। গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করে সিএএ কার্যকর বলে ঘোষণাও করে দেওয়া হয়েছে। এবং তার পরে এই প্রথম বার কলকাতায় পা রেখেছেন অমিত শাহ।
অমিত শাহকে সম্মান জ্ঞাপন রাজ্য নেতত্বের। নিজস্ব চিত্র
সিএএর বিরোধিতায় যে সব রাজ্য সবচেয়ে বেশি উত্তাল হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সেগুলির অন্যতম। সিএএ, এনআরসি বিরোধিতায় তৃণমূল, কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এবং আরও নানা সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচি এখনও চলছে পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু আইনটা যে হেতু শরণার্থীদের বিষয়ে, সে হেতু সিএএ-র বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের বড় অংশের মানুষের সমর্থন পাওয়া বিজেপির পক্ষে জরুরি। কারণ শরণার্থীর ঢল পশ্চিমবঙ্গকে যে ভাবে সইতে হয়েছে, এ দেশের আর ক’টা রাজ্যের ক্ষেত্রে তা রয়েছে, সে নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। সুতরাং সিএএ পাশ হওয়ার পরে পশ্চিমবঙ্গে অমিত শাহের প্রথম সভা রাজনৈতিক ভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এই সভা থেকে অমিত শাহ আবার বললেন, ‘‘সংখ্যালঘুদের ভুল বোঝানো হচ্ছে। সিএএ-তে কারও নাগরিকত্ব যাবে না, এটা নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন।’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করতে গিয়ে সিএএ-র বিরোধিতা করছেন বলে অমিত শাহ এ দিন অভিযোগ করেছেন। যখন মমতা বিরোধী নেত্রী ছিলেন, তখন অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে সংসদেও সরব হতেন, ক্ষমতায় আসার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান বদলে গিয়েছেন— কটাক্ষ করেন অমিত শাহ। শরণার্থীদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘‘শরণার্থীদের ভয় দেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কাগজ দেখাতে হবে, নাগরিকত্ব চলে যাবে, এই করতে হবে, ওই করতে হবে, থানায় যান...। আমি বলছি কোথাও যেতে হবে না।’’ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে ভারতে চলে আসা সব হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, খ্রিস্টানকে বিজেপি সরকার নাগরিকত্ব দেবে— এ দিন ফের ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
শুধু সিএএ ইস্যুতে নয়, তৃণমূলকে এ দিন দুর্নীতি-সিন্ডিকেট রাজ ইস্যুতেও তীব্র আক্রমণ করেছেন অমিত শাহ। নাম না করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারকে নিশানা করেছেন বার বার। আর শেষ পাতে যোগ করেছেন ‘মোদীর নেতৃত্বে উন্নয়ন’-এর চাটনি।
কালীঘাটে পুজো দিলেন অমিত শাহ। নিজস্ব চিত্র
আরও পড়ুন: ‘গো ব্যাক’ স্লোগান তুলে পথে নামল বাম-কংগ্রেস, দেখা গেল না তৃণমূলকে
সিন্ডিকেট রাজ, তোলাবাজি, দুর্নীতি, সরকারি তহবিল নয়ছয় করা— গত কয়েক বছরে যত বার অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন, তত বার এই সব প্রসঙ্গ টেনে তৃণমূলকে আক্রমণ করেছেন। তৃণমূলের দিকে ইঙ্গিত করে এ দিন তিনি বলেন, এদের ‘বিচারধারা’-ই হল দুর্নীতির, তোলাবাজির, অত্যাচারের, হিংসার এবং বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করার। এতেই থামেননি। তিনি আরও বলেন, ‘‘এই বিচারধারা হল, রাজকুমারকে নিজের উত্তরাধিকারী বানানোর বিচারধারা।’’ নাম না করলেও স্পষ্ট বোঝা গিয়েছে, অমিত শাহের ইঙ্গিত কার দিকে। এ দিনের ভাষণে এই ‘রাজকুমার’ কটাক্ষ বার বার তৃণমূলের দিকে ছুড়েছেন তিনি। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পাঠানো টাকা লুঠপাট করে নেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করে তিনি বলেছেন, ‘ভাইপো থেকে পঞ্চায়েত প্রধান পর্যন্ত সবাই’ যুক্ত ‘দুর্নীতির সঙ্গে’।
দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বলতে বলতেই অমিত শাহ এ দিন ঢোকেন উন্নয়নের প্রসঙ্গে। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বাংলার উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ডাক দেন। বামেদের দীর্ঘ দিন সুযোগ দেওয়ার পরে বাংলার মানুষ মমতাকেও দশ বছর দিয়েছেন, এ বার বিজেপি-কে পাঁচ বছর দিন, ‘সোনার বাংলা’ বানিয়ে দেখিয়ে দেব— এ দিন এমনই আহ্বান ছিল অমিতের। দুর্নীতি প্রসঙ্গে মমতাকে তীব্র আক্রমণ করে তিনি বলেন, ‘‘মমতাদিদির রাজত্বে কোনও দিন সোনার বাংলা হবে না।’’ ক্ষমতায় এলে এখনকার সব দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে বলে ঘোষণা করেন তিনি। সে প্রসঙ্গেই তাঁর হুঁশিয়ারি, যাঁরা দুর্নীতি করছেন,‘তাঁদের প্রত্যেককে খুঁজে খুঁজে জেলের গরাদের পিছনে পাঠাব। আমরা কাউকে ছাড়ব না।’’
অমিত শাহের এ দিনের ভাষণে স্পষ্ট যে, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে এখন থেকেই বৃহত্তর কর্মসূচিতে নেমে পড়ল বিজেপি। ‘আর নয় অন্যায়’ ব্যানারেই সেই কর্মসূচি চলবে বলে তিনি বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। যাঁরা মনে করছেন এ রাজ্যে ‘অন্যায়’ চলছে এবং যাঁরা সেই ‘অন্যায়’-এর বিরুদ্ধে শুরু হওয়া লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে চান, তাঁদের জন্য এ দিন একটি ফোন নম্বর দিয়ে গিয়েছেন শাহ। সেই ফোন নম্বরে মিসড্ কল দিলেই ‘আর নয় অন্যায়’ কর্মসূচির শরিক হওয়া যাবে বলে তিনি জানিয়ে গিয়েছেন।
কালীঘাটে অমিত শাহ। নিজস্ব চিত্র
আরও পড়ুন: ‘গোলি মারো…’! অমিতের সভার পথে স্লোগান উঠল কলকাতাতেও
সামনেই পুরভোট প্রায় গোটা বাংলায়। তার আগেই বাংলায় এলেন বিজেপির অন্যতম শীর্ষনেতা। জনসভা করলেন। অনেকে আশা করেছিলেন যে, পুরভোট নিয়েও কিছু বলতে পারেন তিনি। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সে বিষয়ে একটা কথাও উচ্চারণ করেননি। বার বার বুঝিয়ে দিয়েছেন, এখন আর অন্য কোনও দিকে তাকাতে চান না। এখন থেকে বাংলায় দল যে কর্মসূচিই নেবে, তা ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখল করার জন্যই নেবে— স্পষ্ট বার্তা শাহের। ক্ষমতার দিকে এগনোর জন্য তাঁর দলের হাতিয়ার যে হতে চলেছে তিনটে, তা-ও বুঝিয়ে গিয়েছেন। প্রথমত, সিএএ-এনআরসি নিয়ে সুর ক্রমশ চড়িয়ে তৃণমূলের প্রচারের মোকাবিলা করতে হবে, বার্তা শাহের। সিএএ-র বিরোধিতা করা মানে প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে ‘অত্যাচারিত’ হয়ে আসা অ-মুসলিমদের বিরোধিতা করা— এই ধারণা তৈরি করতে হবে, অনুচ্চারিত বার্তা এই রকমই। তাতে মেরুকরণ তীব্র করতে সুবিধা হবে বলে বিশ্লেষকদের মত। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি এবং সিন্ডিকেট রাজ ইস্যু তুলে ধরে গোটা তৃণমূলকে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারকে আক্রমণ করতে হবে— এ-ও বুঝিয়ে দিয়েছেন শাহ। আর তৃতীয়ত তথা সব শেষে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিটাও তুলে ধরতে হবে। বাংলায় বিজেপি ক্ষমতায় এলে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে উন্নয়ন হবে। এই আশ্বাস এখন থেকে জোর দিয়ে তুলে ধরতে হবে। কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে বার্তা বিজেপির প্রাক্তন সভাপতির।
২০২১ সালের ভোটে বাংলায় বিজেপি ক্ষমতা দখল করবেই— এ দিনের সভা থেকে একাধিক বার অমিত শাহ এই দাবি করেছেন। কখনও বলেছেন ‘নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা’ মিলবে, কখনও বলেছেন দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজেপির জয় হবে। তবে একই সঙ্গে বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাস্তবটাও তিনি জানেন। পশ্চিমবঙ্গের লড়াই ‘খুব কঠিন লড়াই’, নিজের ভাষণে এ দিন মেনে নিয়েছেন অমিত শাহ। লড়াইটা যে সহজে জেতা যাবে না, শহিদ মিনারের সমাবেশকে তিনি সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তার পরেই বরাভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেছেন, এই লড়াইয়ে বাংলার বিজেপি কর্মীদের পাশে তিনি সব সময় থাকবেন, বিজেপির নেতৃত্ব ‘কাধে কাঁধ মিলিয়ে লড়বে’।