Amartya Sen

Amartya Sen: স্বাধীনতার ৭৫ পেরিয়েও পরিবর্তন নেই, স্বাধীন চিন্তার চর্চায় কোপ নিয়ে ক্ষুব্ধ অমর্ত্য

পরাধীন ভারতে বিনা অপরাধে বহু ভারতীয়কেই জেলে যেতে হচ্ছিল। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়েও এখনও তা বন্ধ হওয়ার লক্ষণ নেই! আক্ষেপ অমর্ত্য সেনের।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২২ ০৬:০০
Share:

প্রধান অতিথির ভাষণ। আনন্দবাজার পত্রিকার শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে ভিডিয়ো-বক্তৃতা অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের। শনিবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

শতবর্ষ আগে পরাধীন ভারতে বিনা অপরাধে বহু ভারতীয়কেই জেলে যেতে হচ্ছিল আকছার। স্বাধীনতা অর্জনের ৭৫ বছর পেরিয়েও এখনও তা বন্ধ হওয়ার লক্ষণ নেই! আনন্দবাজার পত্রিকার শতবর্ষ উদ্‌যাপনের সভায় আক্ষেপ করছিলেন অমর্ত্য সেন। শনিবার শান্তিনিকেতনে নিজের বাড়ি থেকে ভিডিয়ো-বক্তৃতায় তাঁর মন্তব্য, “দেশ স্বাধীন হল। কারাগারের রূপ বদলাল। কিন্তু বিনা অপরাধে রাজনৈতিক কারাবাস এখনও বড় রকম ভাবেই চলছে।” দেশে স্বাধীন চিন্তার চর্চায় এই মুহূর্তে যে ভাবে কোপ পড়ছে, তা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ।

Advertisement

দেশের মানুষের এই সঙ্কট তুলে ধরার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের দায়বদ্ধতায় জোর দিয়েছেন প্রবীণ চিন্তাবিদ। এ প্রসঙ্গে উঠে এসেছে ইউএপিএ আইনে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্দি উমর খালিদের কথা। অমর্ত্য বলেন, “সাহসী রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা যাঁরা চর্চা করছেন, তাঁদের অনেককেই মার খেতে হচ্ছে সরকারের হাতে, আরোপিত অপরাধের বিচার ছাড়াই। তাঁদের প্রশংসা ভারতবর্ষের বাইরে থেকে অনেক সময় আসে। যেমন, আমরা শুনেছি জোরগলায় অধ্যাপক (নোম) চমস্কির মুখ থেকে। বিনা বিচারে হাজতবাসী উমর খালিদকে সম্মান দিতে চমস্কি চেয়েছেন। কিন্তু এ দেশে তাঁদের সম্মান প্রায় সময়েই বিরল। আনন্দবাজার পত্রিকা যে এই সাহসিকতাকে স্থান দিয়েছে তাদের কাগজে এবং আলোচনায়, তার মধ্যে একটা বড় রকমের মূল্যবোধ আমরা দেখতে পাই।”

শতবর্ষের পরম্পরা বহন করে আনন্দবাজারের বরাবর মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার চেষ্টার কথা সভায় উঠে এসেছে বার বার। আনন্দবাজার কী করে? এর জবাব খুঁজতে গিয়ে বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত সভায় প্রধান সম্পাদক অতিদেব সরকার এ দিন বলেছেন, “এবিপি সাধারণ ভারতীয়ের সেবা করে। তাঁদের শাসকদের নয়।’’ তাঁর মতে, বিশেষত সঙ্কটকালে সাধারণ মানুষের বীরগাথা মেলে ধরাই আনন্দবাজারের কাজ।

Advertisement

দেশ বড়। কিন্তু মানবতা বা দেশের মানুষ আরও বড়। নয় দশক আগে আনন্দবাজারের ‘বালক বয়সের এক জন্মদিনে’ শান্তিনিকেতন থেকে আশীর্বাণী পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাতেও পথনির্দেশ এই মূল্যবোধ ধরে রাখারই।

কবি লেখেন, ‘তোমার লেখনী যেন ন্যায়দণ্ড ধরে / শত্রু মিত্র নির্বিভেদে সকলের ’পরে।/ স্বজাতির সিংহাসন উচ্চ করি গড়ো, / সেই সঙ্গে মনে রেখো সত্য আরও বড়।/ স্বদেশেরে চাও যদি তারো ঊর্ধ্বে ওঠো / কোরো না দেশের কাছে মানুষেরে ছোটো।’ রবীন্দ্র অভিজ্ঞানের এই আদর্শ আঁকড়ে থেকেই বরাবর এগিয়ে চলার কথা বলেছে শতায়ু এ সংবাদ প্রতিষ্ঠান। আজকের আনন্দবাজারের কী দায়িত্ব, তা স্মরণ করিয়ে অমর্ত্যও বলেন, “আনন্দহীনতা আমাদের কাম্য নয়। সেই সঙ্গে সাবলীল ভাবে নানা সমস্যার সমাধানে ভাবার প্রয়োজনও বিপুল। শক্তিমান এবং সুচিন্তিত চিন্তাধারার উপরে জোর কমানো চলবে না। আনন্দবাজার যে আমাদের এই বড় সত্যের দিকে নজর দেওয়ার প্রচেষ্টা করছেন, তার জন্যে আমাদের কৃতজ্ঞতার কারণ সত্যিই আছে।”

স্বাধীন দেশের অনেক আশা পূরণ হলেও ঘাটতির মাপও কিছু কম নয়! বিনা অপরাধে কারাবাস ছাড়াও এ দেশের দারিদ্র, চিকিৎসায় ঘাটতি, সাধারণ মানুষের সম্মানের অভাব, মেয়েদের প্রতি দুর্ব্যবহারের সঙ্কটের কথা বলেছেন জাতির অভিভাবকপ্রতিম অর্থনীতিবিদ। সেই সঙ্গে, নতুন একটি সমস্যা আমাদের জাতীয় ঐক্য পিছিয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করে তাঁর বক্তব্য, “ভারতীয়দের নানা ভাগে ভাগ করার প্রচেষ্টা এবং হিন্দু-মুসলমানের সহকর্মের জায়গায় বিভেদ তৈরি করার প্রচেষ্টা আমাদের খুবই দেখতে হচ্ছে, রাজনৈতিক সুবিধাবাদের জন্য।” অমর্ত্য দেখেছেন, যে ভারতবর্ষ রবীন্দ্রনাথ, মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী, সুভাষচন্দ্র বসু চেয়েছিলেন, তা সরিয়ে একপেশে সাম্প্রদায়িক রাজত্ব করার প্রচেষ্টা দেশের মানুষকে নানা ভাবে দুর্বল করছে। তাঁর কথায়, “এই বিভক্তিকরণের বিরুদ্ধে যে আনন্দবাজার দাঁড়াবার প্রচেষ্টা করেছেন, এতে আমাদের আনন্দের কারণ নিশ্চয় আছে।”

আনন্দবাজারের প্রধান সম্পাদক এ দিন স্পষ্ট বলেন, “মেরুকরণ বা বিভাজন আপাত ভাবে চটকদার। দু’-এক বার ভোটে জেতাতে পারে! তবে তা আখেরে দেশকে দুর্বল করে। অর্থনৈতিক সংস্কার জরুরি। কিন্তু সেটাই সব নয়। প্রতিটি মানুষের সংবিধান কথিত মর্যাদা অর্জনই লক্ষ্য হওয়া উচিত।”

দোল পূর্ণিমার সন্ধ্যায় এই পত্রিকার প্রথম প্রকাশ লগ্নে আনন্দবাজারের রক্তবরণ হরফে ব্রিটিশের জন্য এক ধরনের বিপদসঙ্কেত দেখেছিল দি ইংলিশম্যান পত্রিকা। শাসকের সেই অস্বস্তি আকছার আজকের আনন্দবাজার ঘিরেও দেখা যায়। পূর্বসূরিদের বেঁধে দেওয়া সুর অটুট রাখার কথা বলে আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক ঈশানী দত্ত রায় বলেন, “ব্যক্তিবিশেষ বা রাজনৈতিক দল নয়, আমরা গণতন্ত্রের মৌলিক সূত্রে বিশ্বাসী। সব রকমের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক স্বাধীনতার প্রতি দায়বদ্ধ। সম্মান করি বহুত্বকে। সেই সঙ্গে সত্যের, শব্দের, শ্রেষ্ঠত্বের সাধনায় যেন পথভ্রষ্ট না-হই।”

আনন্দবাজার পরিবারের উৎকর্ষ সাধনার শরিক, প্রাক্তন ও বর্তমান আধিকারিকেরাও সভায় কাব্যে উপেক্ষিত ছিলেন না। তাঁদের কেউ কেউ বৃহত্তর বঙ্গজীবনেও বিশেষ পরিচিত। এবিপি সংস্থার সিইও ধ্রুব মুখোপাধ্যায় পর পর তুলে ধরেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, গ্রন্থাগারিক তথা আনন্দবাজারের শতাব্দীপ্রাচীন তথ্য ভাঁড়ারের অভিভাবক শক্তিদাস রায়, প্রাক্তন সম্পাদক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়, রাজনৈতিক সম্পাদক দেবাশিস ভট্টাচার্য, প্রাক্তন সিইও-এমডি শোভা সুব্রহ্মণ্যন, প্রাক্তন ম্যানেজিং ডিরেক্টর-সিইও দীপঙ্কর দাস পুরকায়স্থ, আনন্দ পাবলিশার্সের এমডি সুবীরকুমার মিত্র, প্রাক্তন বিপণন কর্তা অমিতাভ দত্ত, মুদ্রণ বিশারদ অপূর্ব সেনগুপ্ত, নিরাপত্তা আধিকারিক বুলু বাঁদুরি, ডিস্ট্রিবিউটর অনুপকুমার মাইতির কথা। মঞ্চ জুড়ে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ক্যানভাস। টেবিল ঘড়ি, চায়ের পট শোভিত প্রাতরাশ টেবিলে উপুড় হয়ে দিনের টাটকা আনন্দবাজার পত্রিকা। বঙ্গজীবনে এই আবহমান আনন্দযোগটুকুর পটভূমিতেই এ দিন সংবাদ জগতের কৃতীদের সম্মাননা জ্ঞাপন করা হয়েছে।

আনন্দবাজারের সুবর্ণ জয়ন্তীতে তৎকালীন প্রধান সম্পাদক অশোক কুমার সরকার সম্পাদকীয় কর্তব্যের শ্রেষ্ঠ বিচার ও পুরস্কার হিসেবে পাঠকদের সন্তুষ্টিই যে শেষ কথা, তা বলেছিলেন। ১০০ বছরে সেই এবিপি গোষ্ঠী নতুন-নতুন রাজ্যে, নতুন ভাষায়, নতুন আঙ্গিকে নানা অবতারে ডানা মেলেছে। কাগজ, টিভি, বেতার, পোর্টালেরোজ জম্মু থেকে কন্যাকুমারীর ৩০ কোটি ভারতীয়ের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে তার পরিবেশন। আনন্দবাজারের শতবর্ষ উদ্‌যাপন সভার সঙ্কল্পও প্রতি মুহূর্তে সেই অগুনতি আনন্দসঙ্গীকে ছুঁয়ে থাকল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement