—ফাইল চিত্র।
পাঁচ দশক আগে জার্মানিতে গেলেও আমৃত্যু ভারতীয় পরিচয় ছাড়েননি তিনি। ২০১৯-এ পিঠে অস্ত্রোপচার এবং এ বছর অতিমারির প্রকোপে দেশে আসা হল না-বলেও অস্থির হয়ে ওঠেন। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ভাই দীপঙ্কর আক্ষেপ করছিলেন, ‘‘অক্টোবরে আমার দিদি, ওঁর বোন (ছন্দা বসু) চলে যাওয়াতেও কষ্টে ছিলেন।’’ অলোকরঞ্জনের স্ত্রী ট্রুডবার্টা ২০০৫-এ প্রয়াত হয়েছেন। শেষ কয়েকটা দিন কবি-শিক্ষকের অসুস্থতায় পাশে থাকেন সুহৃদ এলিজ়াবেথ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জার্মানিতে অলোকরঞ্জন (৮৭) হির্শবার্গে নিজের বাড়িতেই প্রয়াত হন।
দীপঙ্করবাবুর কথায়, ‘‘বড়দা শেষ এগারো দিন কিছু খেতে পারছিলেন না। ‘ড্রিপ’ দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। তবে শেষ মুহূর্তে প্রশান্তিতেই তাঁর জীবনাবসান হয়েছে।’’ জার্মানিতে আংশিক লকডাউনের জন্য এখনই তাঁর শেষকৃত্য করা যায়নি। দেহ সংরক্ষণ করা হয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য-বাংলা বিভাগে, হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারততত্ত্বের ছাত্রছাত্রী থেকে বাংলা কবিতার পাঠকেরা বিচলিত এই প্রয়াণে। অলোকরঞ্জনের অননুকরণীয় সরস বাংলা বলার শৈলী সজীব অনুরাগীমহলে।
জয় গোস্বামীর সংযোজন: অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত নেই মানে বাংলা কবিতাজগতের সামনে এক গুরুদশা উপস্থিত। ‘যৌবনবাউল’ তাঁর প্রথম কবিতার বই। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ কবিতাপত্রে অলোকরঞ্জনের কবিতার উপস্থিতি অবধারিত করে তোলেন। আলোক সরকারের ‘শতভিষা’ কাব্যপত্রেও প্রায় প্রতি সংখ্যায় লিখতেন তিনি। সম্ভবত ১৯৫৪ সাল থেকে অলোকরঞ্জন ‘দেশ’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখে এসেছেন।
‘যৌবনবাউল’-এর অলোকরঞ্জন কিন্তু নিজেকে সম্পূর্ণ বদলে নিতে লাগলেন তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থসমূহে। ‘নিষিদ্ধ কোজাগরী’ তাঁর দ্বিতীয় বই, বাংলা কবিতার এক নতুন রূপকে হাজির করল। তাঁর পরের বই ‘রক্তাক্ত ঝরোখা’ পেরিয়ে তিনি এসে পৌঁছলেন ‘ছৌ-কাবুকির মুখোশ’ কাব্যগ্রন্থে। আনন্দ পাবলিশার্স কর্তৃক প্রকাশিত এই বইয়ে অলোকরঞ্জনের কবিতার আবার এক নতুন রূপ পাঠক দেখতে পেলেন। আজ অবধি তিন খণ্ড কবিতাসমগ্র বেরিয়েছে তাঁর। আরও তিন খণ্ড এখনই বেরোতে পারে, এতই তাঁর বইয়ের সংখ্যা।
এক আন্তর্জাতিক মনের অধিকারী এই কবি। সমস্ত ভুবনকে তিনি ধারণ করে আছেন তাঁর কবিতায়। সারা পৃথিবীর শরণার্থী ও উদ্বাস্তুদের কথা ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে। এ বছর বইমেলায় অলোকরঞ্জনের যে কবিতার বইটি বেরিয়েছে তার নাম ‘পাহাড়তলির বাস্তুহারা’। নামকরণ শুনেই বোঝা যায় সমস্ত পৃথিবীর মানুষ তাঁর কবিতায় ধরা দিয়েছে তাঁর নিকট আত্মীয় ও পরিজন রূপে।
কবিতা রচনার পাশাপাশি অলোকরঞ্জন গদ্যও লিখেছেন প্রচুর। ‘শিল্পিত স্বভাব’ ও ‘স্থির বিষয়ের দিকে’ তাঁর এমন দু’টি প্রবন্ধগ্রন্থ, যা যে কোনও চিন্তকের নিত্যসঙ্গী হওয়ার যোগ্য। গদ্যসমগ্রও বেরিয়েছে তাঁর একাধিক।
অলোকরঞ্জন অনুবাদেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন ‘সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত’ নামের এক মহার্ঘ অনুবাদসংগ্রহ, যেখানে প্রায় সারা পৃথিবীর কবিদের কবিতার অনুবাদ পাওয়া যাবে। এ ছাড়া ‘প্রাচী-প্রতীচীর মিলনবেলার পুঁথি’ নামক একটি বই অনুবাদ করেছেন, যা জার্মান কবি গ্যোয়টের লেখা, এটি তাঁর একটি বিশিষ্ট শিল্পকর্ম। অলোকরঞ্জনের অনূদিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে ব্রেশটের কবিতা ও গান, কবি হ্যোল্ডারলিনের কবিতার অনুবাদ ‘নিয়তি ও দেবযান’ ও ভোলফ বিয়ালমানের অনুবাদ। তবে এ সকল বই এখন খুবই দুষ্প্রাপ্য।
স্বকীয় কাব্য রচনা, সারা পৃথিবীর কবিদের কবিতার অনুবাদকর্ম, গদ্যের মধ্যে সম্পূর্ণ নতুন ও চমকপ্রদ একটি স্টাইলের সৃষ্টি তিনি একই সঙ্গে করে গেছেন। এমনকি অলোকরঞ্জনের মৌখিক বাংলা ভাষাও ছিল আশ্চর্য নতুন শ্রুতিমধুর, যা থেকে থেকেই শ্রোতাকে চমৎকৃত করত। বিভিন্ন সভায় তাঁর ভাষণ শুনতে বাংলা আকাদেমির প্রেক্ষাগৃহ উপচে পড়ত।
সাহিত্যের জন্যে সম্মানও পেয়েছেন অনেক। আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার, কবীর সম্মান ও জার্মান দেশ থেকে তাঁকে দেওয়া হয়েছে গ্যোয়টে পদক।
সর্ব অর্থেই তিনি ছিলেন এক জন সম্পূর্ণ কবি। বাঙালি প্রকাশকদের উচিত, আর দেরি না করে অলোকরঞ্জনের সকল দুষ্প্রাপ্য বইয়ের পুনর্মুদ্রণ করা ও আজকের নতুন কবিদের সঙ্গে যাতে অলোকরঞ্জনের পূর্ণপরিচয় ঘটে, তার জন্য সচেষ্ট হওয়া।