বামেদের হাতে থাকা শিলিগুড়ি পুরসভাকে রাজ্য সরকার বঞ্চিত করছে, এই অভিযোগে বৃহস্পতিবার শিলিগুড়ি শহরে মিছিল করল সিপিএম। মহানন্দা সেতু থেকে হিলকার্ট রোড হয়ে মিছিল যায় মহকুমাশাসকের দফতরে। সেখানে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। — সন্দীপ পাল
পর্যটনের মরসুম এল বলে! অথচ রাস্তা সারাইয়ের জন্য রাজ্য সরকারের কাছ থেকে টাকা পাচ্ছে না মুর্শিদাবাদ পুরসভা। এ বছরের প্রাপ্য পরের কথা, পুরপ্রধান বিপ্লব চক্রবর্তীর অভিযোগ, রাস্তা খাতে গত বছরের অর্ধেক টাকাও এখনও আটকে রেখেছে নবান্ন!
‘সকলের জন্য বাড়ি’ প্রকল্পে নদিয়ার তাহেরপুর পুরসভার পাওয়ার কথা ছিল ৪ কোটি টাকা! বিশ বার তাগাদা দিয়েও রাজ্য পুর দফতরের থেকে ৪০ লক্ষ টাকার বেশি মেলেনি বলে অভিযোগ পুরপ্রধান রতনরঞ্জন রায়ের!
পেনশন ও মজুরি খাতে যে টাকা পাওয়ার কথা ছিল, নবান্ন থেকে বর্ধমানের দাঁইহাট পুরসভায় তা বহু মাস ধরেই আসছে না। বেতন না-পেয়ে সাফাই কর্মীরা তাই বার কয়েক ঘেরাও করছেন পুরপ্রধানকে, সাধারণের ভোগান্তি বাড়িয়ে কাজও বন্ধ করে দিচ্ছেন মাঝে মধ্যেই।
গত ছ’মাস ধরে এমনই কাঁদুনি গাইছে মুর্শিদাবাদের কান্দি, উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগর-মজিলপুর পুরসভাও। আর শিলিগুড়ির ব্যাপারটা একেবারেই অনন্য! বুধবার অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্য। অমিত মিত্র নাকি তাঁকে পরিষ্কারই জানিয়ে দিয়েছেন, বাম সরকার এত দেনা করে গিয়েছিল যে, শিলিগুড়িকে দেওয়ার মতো টাকা নেই!
বাংলায় মোট ১২৫টি পুরসভার মধ্যে এখন ১১৪টিই তৃণমূলের দখলে। পাহাড়ে মোর্চার দখলে থাকা ৪ পুরসভা বাদ দিলেন, বাকি বাংলায় তৃণমূলী ঝঞ্ঝাকে ঠেকিয়ে বিক্ষিপ্ত খুঁটির মতো ৭টি পুরসভা এখনও আগলে রয়েছে বাম-কংগ্রেস। যাদের সমস্বর অভিযোগ এখন একটাই, ভোটে না-পেরে তাদের ভাতে মারছে শাসক দল। যাতে হয় তাঁরা দলবদল করে তৃণমূলে যোগ দিতে বাধ্য হন, নইলে উন্নয়নের কাজ না-করতে পেরে জনপ্রিয়তা খুইয়ে পরের ভোটে গোহারা হারেন।
এই সাত পুরসভার প্রধানেরই মোদ্দা অভিযোগ, এমন সব প্রকল্পে টাকা আটকে রাখা হচ্ছে যেগুলির মাধ্যমে মানুষ সরাসরি উপকৃত হতে পারেন। তার প্রথম তালিকায় রয়েছে, সবার জন্য বাড়ি
প্রকল্প। তাহেরপুরের মতো দাঁইহাটেও এই প্রকল্পে নবান্ন প্রায় ৯০ শতাংশ টাকা আটকে রেখেছে বলে অভিযোগ। সেখানে গৃহ নির্মাণের জন্য অনুদান পাওয়ার কথা ৬৬৩টি পরিবারের। গৃহ নির্মাণ প্রকল্পের পাশাপাশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে না পানীয় জল ও রাস্তার প্রকল্পে। মুর্শিদাবাদের পুরপ্রধানের বক্তব্য, ইউপিএ জমানায় অনুমোদিত জল প্রকল্পের টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না। তবে শিলিগুড়ি পুরসভার বকেয়া প্রাপ্য সব থেকে বেশি— প্রায় ৮৫ কোটি টাকা।
বস্তুত গত পুরসভা ভোটের ফলাফলে শাসক দল কিন্তু গোড়াতেই ১১৫টি আসন জেতেনি। রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও এমন কিছু পুরসভা ছিল, যেখানে খাতা পর্যন্ত খুলতে পারেনি তৃণমূল। যেমন পুরুলিয়ার ঝালদা পুরসভা বা মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা বা উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াচক পুরসভা। কিন্তু বিরোধী দলের কাউন্সিলর ভাঙিয়ে ওই পুরসভাগুলিও দখল করে নিয়েছে তৃণমূল। দল ভাঙানোর নেপথ্যে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের ভূমিকা নিয়ে অধীর চৌধুরী-সূর্যকান্ত মিশ্ররা প্রশ্ন তো তুলেছেনই, সেই সঙ্গে অনেক দলত্যাগী কাউন্সিলরেরও বক্তব্য ছিল, অর্থনৈতিক অবরোধ এড়াতেই তাঁরা শাসক দলে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, কংগ্রেস বা সিপিএমে থাকায় কাজ করার টাকা মিলছে না। দল বদল করলে সেই সাহায্য যে মিলবে, নবান্ন থেকে সেই আশ্বাস মিলেছে।
ঘটনাচক্রে সেই যুক্তি দেখিয়েই এ বার দল বদলের জন্য পা বাড়িয়ে রয়েছেন ইসলামপুর পুরসভার পুরপ্রধান কানহাইয়ালাল অগ্রবাল। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে চেয়ারম্যান তিনি। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ‘‘বার বার বলা সত্ত্বেও ইসলামপুরের উন্নয়নের জন্য টাকা পাচ্ছি না। কাজ করতে না পারলে পরের বার লোকে রাখবে কেন? এমনকী ডালখোলার মতো ছোট পুরসভা প্রচুর টাকা পেলেও ইসলামপুরের ভাগে কানাকড়ি জুটছে না।’’ কংগ্রেসের ৯ জন কাউন্সিলরকে নিয়েই তাই তৃণমূলে নাম লেখাবেন বলে ঠিক করেছেন কানহাইয়ালাল। তবে এ-ও জানিয়েছেন, ‘‘নিজের জায়গাটা ঠিক হলে তবেই যাব।’’ একই ভাবে শাসক দলের দিকে পা বাড়িয়ে কান্দি পুরসভায় কংগ্রেসের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীও। সুতোয় ঝুলছে তাহেরপুরের ভবিষ্যৎ। সেখানে ১৩টি আসনের মধ্যে ৮টিতে জিতেছিলেন বামেরা। ৫টিতে তৃণমূল। সিপিএম জেলা কমিটির সদস্য সুপ্রতিম রায় এ দিন বলেন, ‘‘আমাদের কাউন্সিলরদের ভাঙাতে এখন ওঁরা সব রকম চেষ্টা শুরু করে দিয়েছেন। সিপিএমের এক মহিলা কাউন্সিলরের বাড়িতে গিয়ে দুই অচেনা যুবক ক’দিন আগে বলে গেছে— সাবধানে থাকবেন!’’
পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম অবশ্য কোনও অভিযোগই মানতে নারাজ। তাঁর কথায়, ‘‘ওরা কাজ করতে জানে না, তাই করতে পারে না। উন্নয়নের টাকা বরাদ্দে সরকার কোনও বৈষম্য করে না।’’
মন্ত্রীর এই যুক্তি মানতে নারাজ বিরোধী নেতা আবদুল মান্নান। তাঁর কথায়, ‘‘এই জমানার স্লোগান একটাই— তৃণমূলে এলে তবে কাজ পাবে, টাকা পাবে। নইলে নয়!
এমন জঘন্য রাজনীতির দৃষ্টান্ত ভূভারতে নেই।’’
সব মিলিয়ে বিরোধী দখলে সাত পুরসভার ভবিষ্যৎও এখন পুরোদস্তুর অনিশ্চিত। পালাবদল হতে পারে যে কোনও দিন, যে কোনও মুহূর্তে!