সাত দিনে চিকিৎসার বিল ৭ লক্ষ টাকা! যুবকের মৃত্যু ঘিরে চাপে হাসপাতাল

মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের পরে দু’দিনও পেরোল না। ফের শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের অমানবিক মুখ দেখল কলকাতা।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৩৭
Share:

সঞ্জয় রায়

মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের পরে দু’দিনও পেরোল না। ফের শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের অমানবিক মুখ দেখল কলকাতা।

Advertisement

দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত সঞ্জয় রায় ভর্তি ছিলেন অ্যাপোলো হাসপাতালে। এসএসকেএমে বেডের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কয়েক লক্ষ টাকার বকেয়া বিল না মেটানো পর্যন্ত অ্যাপোলো কর্তৃপক্ষ সঞ্জয়কে ছাড়তেই চাননি বলে তাঁর পরিবারের অভিযোগ। বৃহস্পতিবার সারা দিন টালবাহানার পরে রাত সাড়ে নটায় ওই যুবককে ছাড়া হয় বলে পরিজনদের দাবি। শুক্রবার ভোরে এসএসকেএমেই মারা যান সঞ্জয়।

ডানকুনি নন্দনকানন এলাকার বাসিন্দা, ৩০ বছরের সঞ্জয় চাকরি করতেন একটি বেসরকারি সংস্থায়। গত ১৬ তারিখ হাওড়ার কাছে বালটিকুরিতে তাঁর মোটরবাইকে ধাক্কা মারে একটি ম্যাটা়ডোর। প্রথমে স্থানীয় ইএসআই হাসপাতাল, সেখান থেকে অ্যাপোলোয় নিয়ে আসা হয় তাঁকে। ভেন্টিলেশনে ছিলেন সঞ্জয়। সাত দিনে চিকিৎসার বিল হয়েছিল ৭ লক্ষ ২৩ হাজার টাকা। পরিবারের দাবি, অ্যাপোলোকে তাঁরা জানিয়েছিলেন, তাঁদের আর্থিক সামর্থ্য নেই। বহু কষ্টে এসএসকেএমে বেড জোগাড় করেছেন। সেখানেই নিয়ে যেতে চান রোগীকে। এ-ও জানিয়েছিলেন, পুরো বিল মেটানোর সাধ্য তাঁদের নেই। কিন্তু শোনেনি অ্যাপোলো।

Advertisement

অভিযোগের পরের অংশটা আরও মারাত্মক। পরিবারের দাবি, বহু আবেদন-নিবেদনের পরে শেষ পর্যন্ত ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিট-এর কাগজপত্রও অ্যাপোলোয় জমা রাখতে হয়েছিল তাঁদের!

এ দিন সঞ্জয়ের মৃত্যুর পরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এসএসকেএম চত্বর। পরিবারের পুরো ক্ষোভটাই অবশ্য ছিল অ্যাপোলোর বিরুদ্ধে। এই সময়ে হঠাৎ ঘটনাস্থলে এসে তৃণমূল নেতা মদন মিত্র অভিযোগ করেন, মৃতের বাড়ির দলিলও আটকে রেখেছে অ্যাপোলো। ফোনে ওই বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে রীতিমতো হুমকি দিয়ে সব টাকা এবং কাগজপত্র ফেরতের দাবি তোলেন প্রাক্তন পরিবহণ মন্ত্রী। তবে সঞ্জয়ের বাড়ির লোকেরা দলিল আটকে রাখার কোনও অভিযোগ করেননি।

অ্যাপোলো ও এসএসকেএমের কাছে ঘটনার রিপোর্ট চেয়েছে স্বাস্থ্য ভবন। অ্যাপোলোর লাইসেন্স বাতিলেরও দাবি তুলেছেন সঞ্জয়ের প্রিয়জনেরা। এ দিন বিধাননগরের পুলিশ কমিশনারের কাছে অ্যাপোলোর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছে রোগীদের স্বার্থে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘পিপল ফর বেটার ট্রিটমেন্ট’ (পিবিটি)।

আরও পড়ুন:

খোঁজ শুরু হতেই মিলিয়ে গেল বাড়তি টাকার দাবি

যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করে অ্যাপোলোর চিফ অপারেটিং অফিসার জয় বসু শুক্রবার বলেছেন, ভর্তির সময়েই সঞ্জয়ের পেটে-বুকে গুরুতর চোট ছিল। অবিরাম রক্তক্ষরণও হয়েছিল। দু’টি ধমনীতে রক্তক্ষরণের উৎস বন্ধ করার জন্য অ্যাঞ্জিও এম্বোলাইজেশন করা হয়। দিন কয়েক পর থেকে ভেন্টিলেশনেই ছিলেন সঞ্জয়কে। জয়বাবুর দাবি, ‘‘বৃহস্পতিবার সকালে মেডিক্যাল বোর্ড বসে। বোর্ডের মতামত ওঁর পরিবারকে জানানো হয়েছিল। ওঁরাই তখন আর্থিক সমস্যার কথা জানিয়ে এসএসকেএমে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। ওই রাতেই ট্রমা কেয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে সঞ্জয়কে এসএসকেএমে পাঠানোর বন্দোবস্ত হয়।’’

বা়ড়ির দলিল চাওয়ার কথাও অস্বীকার করেন জয়। তাঁর দাবি, টাকা দিতে না পারায় এক রকম জোর করেই ফিক্সড ডিপোজিটের কাগজ হাসপাতালে জমা দিয়েছিলেন সঞ্জয়ের পরিবারের লোকেরা। যদিও কান্নায় ভেঙে পড়ে সঞ্জয়ের মা সোমাদেবী বলেছেন, ‘‘আমরা কেন নিজে থেকে শেষ সম্বলটুকু ও ভাবে জমা রাখতে চাইব? অ্যাপোলো আমাদের এত চাপ দিচ্ছিল যে, ওই কথা না বলে উপায় ছিল না।’’ সঞ্জয়ের পরিজনেরা জানিয়েছেন, অ্যাপোলোকে নগদে ৪ লক্ষ ৩৩ হাজার টাকা দিয়েছিলেন তাঁরা। বাকি অঙ্কের টাকার অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক দেওয়া হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ চেক নিতে রাজি না হওয়ায় ৩ লক্ষ ৬০ হাজার টাকার ফিক্সড ডিপোজিটের কাগজ জমা দেওয়া হয়েছিল। অ্যাপোলো এ দিন জানিয়েছে, ফিক্সড ডিপোজিটের কাগজ তো বটেই, ওই ৪ লক্ষ ৩৩ হাজার টাকাও মানবিকতার খাতিরে ফেরত দেবে তারা।

সঞ্জয়ের স্ত্রী রুবির কথায়, ‘‘আমাদের বলা হয়েছিল, ‘অপারেশন করতে হবে। আট-দশ লক্ষ টাকা দরকার। আপনারা প্রস্তুত তো?’ আমরা বলেছিলাম, যে ভাবে হোক চিকিৎসা শুরু করুন। টাকা জোগাড় করব।’’ রুবির অভিযোগ, বারবার তাঁরা বিলের বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। কিন্তু হাসপাতাল স্পষ্ট কিছু জানায়নি। খরচ নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আঁচ পেয়ে তাঁরা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দফতরের মাধ্যমে এসএসকেএমের আইটিইউ-এ একটি শয্যা জোগাড়ের চেষ্টা করছিলেন। শেষ পর্যন্ত তা মিলেও যায়। সঞ্জয়ের বাবা অনিল রায় বলেন, ‘‘অ্যাপোলোতে জানাতেই ওঁরা বলেন, ‘আগে টাকা জমা দিন। তার পর রোগীকে ছাড়া হবে।’ এসএসকেএম থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, শয্যা খালি রাখা যাবে না, তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে। আমরা অসহায় হয়ে পড়ি। ওঁরা বাকি টাকাটা চেকে নিতে রাজি হননি। আমরা তখন বলি, আমাদের জামিনদার হিসেবে আটকে রাখুন, কিন্তু রোগীকে যেতে দিন। ওঁরা সেটাও শোনেননি।’’

আড়াই বছরের ছেলের বাবা সঞ্জয়ই ছিলেন একমাত্র রোজগেরে। এ দিন দুপুরে স্বামীর মৃতদেহের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা রুবি বললেন, ‘‘সংসারটা পুরো ভেসে গেল। মমতাদি কি দোষীদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন? বাঁচাতে পারবেন আমাদের সংসারটাকে?’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement