—ফাইল চিত্র।
দুপুরেই কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। এজলাসে বসে বিচারপতি প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন বিচারপতি সৌমেন সেনের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু হবে না? ঘটনাচক্রে, সেই মন্তব্যের কয়েক ঘণ্টা পরেই রাতে বিচারপতি সৌমেন সেনের বেঞ্চ থেকে সরে গেল শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত মামলা। রাতেই কলকাতা হাই কোর্ট একটি নির্দেশিকা জারি করে জানাল, আগামী সোমবার থেকে শিক্ষা সংক্রান্ত মামলার শুনানি হবে অন্য ডিভিশন বেঞ্চে। তবে কেন এই হঠাৎ বদল তার কারণ জানানো হয়নি নির্দেশিকায়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে এক বেনজির ঘটনার সাক্ষী হয় কলকাতা হাই কোর্ট। এক বিচারপতির বিরুদ্ধে আর এক বিচারপতি এজলাসে বসেই একের পর এক অভিযোগ করেন। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, বিচারপতি সেন সম্প্রতি যা যা আচরণ করছেন, তাতে মনে হচ্ছে, তিনি কোনও একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করছেন। বিচারপতি এ-ও বলেন হাই কোর্টের এক বিচারপতিকে নিজের ঘরে ডেকে রাজনৈতিক নেতার মতো নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি সেন। সেই অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পরই কলকাতা হাই কোর্টে তোলপাড় শুরু হয়। আর তার পরেই রাতে একটি নির্দেশিকা জারি করা হয় হাই কোর্টের তরফে।
নির্দেশিকায় জানানো হয়, বিচারপতি সেনের বেঞ্চে থাকা সমস্ত মামলা বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চ শুনবে। আগামী শুক্রবার থেকে রস্টার পরিবর্তনের নির্দেশ কার্যকর হবে। ২৯ জানুয়ারি থেকেই শিক্ষা সংক্রান্ত মামলার শুনানি নতুন ডিভিশন বেঞ্চে হবে।
এই ঘটনার সূত্রপাত রাজ্যের সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ভর্তির অনিয়ম সংক্রান্ত মামলা নিয়ে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ওই দুর্নীতিতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন বুধবার। কিন্তু বুধবারেই ওই নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেন ডিভিশন বেঞ্চের বিচারপতি সেন। পরে বৃহস্পতিবার সকালে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে সিবিআইয়ের দায়ের করা এফআইআরও খারিজ করে দেয় বিচারপতি সেন এবং বিচারপতি উদয়কুমারের ডিভিশন বেঞ্চ। এর পরেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় মামলা সংক্রান্ত তাঁর নির্দেশনামায় বিচারপতি সেনের আচরণের কথা লেখেন । তাঁর অভিযোগ, বিচারপতি সেন ‘রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকা’ ব্যক্তির মতো আচরণ করছেন। যা করছেন, তা ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য’ নিয়ে করছেন। ভরা এজলাসেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় প্রশ্ন তোলেন, “কেন বিচারপতি সেনের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে না? মেডিক্যাল কলেজের মামলা সংক্রান্ত নির্দেশনামায় তিনি সে কথা লেখেনও।”
কেন এ কথা বলছেন, এজলাসে তাঁর ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘বড়দিনের ছুটির আগে বিচারপতি অমৃতা সিংহকে নিজের চেম্বারে ডেকেছিলেন বিচারপতি সেন। সেখানে বিচারপতি সিংহকে তিনি রাজনৈতিক নেতার মতো নির্দেশ দিয়েছিলেন।’’ কী নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি সেন, এজলাসে বসেই তা-ও বিস্তারিত বলে ছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘বিচারপতি সেন বলেছিলেন, প্রথমত, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ রয়েছে। তাঁকে বিরক্ত করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, বিচারপতির অমৃতা সিংহের এজলাসে শুনানির লাইভ স্ট্রিমিং বন্ধ করতে হবে। তৃতীয়ত, প্রাথমিকের দু'টি মামলাও খারিজ করতে হবে বিচারপতি সিংহকে।’’
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এজলাসে বসেই জানিয়ে দেন, তিনি ওই ‘তথ্য’ জেনেছেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিংহের কাছ থেকেই। শুধু তা-ই নয়, ওই একই ‘তথ্য’ বিচারপতি সিংহ জানিয়েছেন কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকেও।
এই মুহূর্তে রয়েছে প্রাথমিকের অনেকগুলি মামলা বিচারপতি সিংহের বেঞ্চে বিচারাধীন। এর মধ্যে কয়েকটি মামলায় বিচারপতি সিংহ কিছু নির্দেশ দিয়েছিলেন রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়েও। বৃহস্পতিবার বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সেই নির্দেশ নিয়ে বা অভিষেককে নিয়ে কিছু না বললেও বলেন, ‘‘বিচারপতির সেন স্পষ্টতই একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করছেন। ওই মামলায় রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকা ব্যক্তির মত আচরণ করছেন বিচারপতি সেন। তিনি কয়েক জন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। তাই সুপ্রিম কোর্টের উচিত তাঁর (বিচারপতি সেনের) সমস্ত নির্দেশ খারিজ করা।’’
বিচারপতি ওই নির্দেশনামায় আরও একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন বিচারপতি সেনের বিরুদ্ধে। বিচারপতি বলেন, ‘‘বিচারপতি সেনকে তো অনেক আগেই বদলির নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তা সত্ত্বেও দু’বছর ধরে তাঁর বদলি হচ্ছে না কেন?’’ প্রসঙ্গত, দু’বছর আগেই বিচারপতি সেনকে ওড়িশা হাই কোর্টে বদলি করার সুপারিশ করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘কিন্তু কোন কারণে তাঁর বদলি হয়নি তা অজানা। দেশের প্রধান বিচারপতিকে এই বিষয়টিও দেখতে অনুরোধ করব। অন্য বিচারপতিদের বদলি ওই সুপারিশ মেনেই হয়। এই বদলি আটকাতে কার হাত রয়েছে সেটিও দেখার অনুরোধ করব।’’
দুপুর ১টা নাগাদ বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ওই নির্দেশনামা কলকাতা হাই কোর্ট এবং দেশের প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আর হাই কোর্টের তরফে নতুন নির্দেশিকা জারি করা হয় রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ।