দণ্ডিত: আদালতে তোলা হচ্ছে উদয়ন দাসকে। ছবি: অভিজিৎ সিংহ
করোনা-আবহে এত দিন শুনশান থাকা বাঁকুড়া আদালতে বুধবার দিনটা শুরু হয়েছিল পুলিশি সক্রিয়তায়। এ দিন বাঁকুড়ার যুবতী আকাঙ্ক্ষা শর্মাকে খুনে অভিযুক্ত উদয়ন দাসের রায়কে ঘিরে খানিকটা বদলে গিয়েছিল বাঁকুড়া আদালতের ছবি। ভিড় করেছিলেন কৌতূহলী লোকজনও।
কিন্তু স্যুট পরিহিত ক্লিন শেভড যে উদয়নকে সাধারণ মানুষ তিন বছর আগে আদালতে দেখেছিলেন, এ দিন পুলিশি ঘেরাটোপে তাকে দেখে প্রথমে অনেকে অবাক হন। মুখে চাপ দাড়ি। নীল জিনস ও কালো ফুলহাতা টি শার্ট পরা উদয়নকে পুলিশের গাড়ি থেকে নামতে দেখা যায়। এ দিন কোর্ট লকআপে যাওয়ার পথে পুলিশের ঘেরাটোপের মধ্যেই সে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলে, “রায় হয়ে গেলে, কথা বলব।”
সোশ্যাল মিডিয়ার সূত্রে ২০০৮ সালে আকাঙ্ক্ষা ও উদয়নের পরিচয়। পরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। উদয়ন নিজেকে আমেরিকায় কর্মরত দাবি করে। সে দেশে ইউনিসেফে আকাঙ্ক্ষার চাকরির ব্যবস্থা করেছে বলে তাঁকে ডেকে পাঠায়। তাঁকে ভুয়ো নিয়োগপত্রও দিয়েছিল উদয়ন। ২০১৬ সালের ২৩ জুন আকাঙ্ক্ষা বাঁকুড়া শহরের রবীন্দ্রসরণির বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি আকাঙ্ক্ষা। আমেরিকায় রয়েছেন বলে আকাঙ্ক্ষার ফোন থেকে তাঁর বাড়িতে নিয়মিত মেসেজ আসত। মাঝে উদয়ন বাঁকুড়ার বাড়িতে ঘুরেও যায়। কিন্তু মাসের পর মাস ধরে মেয়ে ফোনে কথা না বলায় সন্দেহ হয় শর্মাদের।
৫ ডিসেম্বর তাঁরা বাঁকুড়া সদর থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন। পুলিশ জানতে পারে, আকাঙ্ক্ষার মোবাইলের ‘টাওয়ার লোকেশন’ দেখাচ্ছে ভোপালের সাকেতনগরে, যেখানে উদয়নের বাড়ি। কিন্তু সেখানে গিয়েও উদয়নের দেখা পাননি শর্মারা। ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি বাঁকুড়া সদর থানায় উদয়নের বিরুদ্ধে আকাঙ্ক্ষাকে অপহরণের অভিযোগ দায়ের করেন তাঁরা।
‘‘উদয়নের বাবা হাওড়ার লোক, বাঙালি। চাকরি নিয়ে ভোপালে যান। মা প্রবাসী বাঙালি। সরকারি চাকরি করতেন। ছোটবেলায় চটকহীন চেহারার জন্য বন্ধুরা উদয়নকে খেপাত। সেই থেকে ওর মধ্যে ‘যোগ্য জবাব’ দেওয়ার রোখ চাপে। অঙ্কে কাঁচা হলেও মায়ের চাপে উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে ফেল করে। দূরশিক্ষায় পাশ করে ভর্তি হয় ভিলাইয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। প্রথম দু’টি সিমেস্টারে ফেল করে আর পড়েনি। ভুয়ো মার্কশিট বানিয়ে বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে ওড়াত। চার বছর পরে ‘প্লেসমেন্ট’ না হওয়ায় মায়ের কাছে ধরা পড়ে। দুষ্কর হয় বাড়িতে থাকা। বাবা স্বেচ্ছাবসর আর মা অবসর নেওয়ায় হাতে অনেক টাকা ছিল। উদয়ন চাইছিল চটজলদি বড়লোক হতে। ক্রমশ ভিতরে ঠান্ডা মাথার খুনি জেগে ওঠে। প্রতিটা খুনের পরে, অনেক সময় পেয়েছিল নিজেকে গুছিয়ে নিতে। তখন বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার হিসেবে দেখেছি, ওর মধ্যে অনুশোচনা ছিল না।’’
সুখেন্দু হীরা, ডিসি (রিজ়ার্ভ ফোর্স), কলকাতা পুলিশ
‘‘কোনও সম্পর্কের প্রতিই উদয়নের কোনও টান ছিল না। প্রথমে নিজের বাবা-মা ও পরে নিজের ‘প্রেমিকা’ আকাঙ্ক্ষাকে খুন করায় অভিযুক্ত সে। আকাঙ্ক্ষা মামলায় সাজা পেল। তবে উদয়নের মনে কোনও আক্ষেপ ছিল বলে মনে হয়নি। কখনও নিজের দোষ স্বীকার করেছে, আবার কখনও আইনের সাহায্য নিয়ে নিজের সাজা কমাতেও সচেষ্ট হয়েছে। তদন্তের ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসাবাদে নিজেকে আপাত নিরীহ প্রমাণ করতে নানা মিথ্যে কথা বলে গিয়েছে। ভিন্ রাজ্যে আকাঙ্ক্ষা খুন হওয়ায় আদালতের সামনে সমস্ত তথ্য প্রমাণ তুলে ধরতে বাঁকুড়ার পুলিশকে অনেক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে তদন্তকারী আধিকারিক কৌশিক হাজরা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। দোষী যাতে ছাড়া না পায়, সে জন্য সব সময় সচেষ্ট ছিলেন। বিচারপ্রক্রিয়ায় তথ্য-প্রমাণ নিয়ে কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না, সে দিকেও নজর ছিল। শেষ পর্যন্ত উদয়ন দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজা পেল।’’
কোটেশ্বর রাও, বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার
‘‘সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের একটা মিথ্যার জগত তৈরি করে সচেতন ভাবে উদয়ন অপরাধ করেছে, অন্তত আকাঙ্ক্ষা মামলার ক্ষেত্রে সেটা বলা যায়। নিজের বাবা-মাকে খুনেও সে অভিযুক্ত। যদি কেউ ভাবেন, মানসিক অসুস্থতার কারণে সে এমনটা করেছে, তবে বলব— ঠিক নয়। অনেক ক্ষেত্রেই মানসিক অসুস্থতার নাম করে অপরাধী নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। এই চেষ্টা বহু যুগ ধরে চলে আসছে। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো। যারা মৃত্যুদণ্ডের সাজা পায়, তাদের মধ্যে নিজেকে বাঁচাতে নানা অজুহাত দিতে দেখা যায়। এদের অনুশোচনা বোধ থাকে না। একের পরে এক খুন করলেও সাধারণত এদের মধ্যে কোনও পরিবর্তন আসে না। যাদের মধ্যে ছোটবেলা থেকে কোনও ভুল কাজের জন্য অনুতাপ বোধ কম, তাদের কেউ কেউ বড় হয়ে অনেক সময় নানা রকম অপরাধমূলক কাজে যুক্ত হতে পারে। অনেকে শুধরে যায়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা হয় না।’’
জয়রঞ্জন রাম, মনোবিদ
পুলিশ গিয়ে ২ ফেব্রুয়ারি উদয়নকে গ্রেফতার করে। তার বাড়িতে সিমেন্টের বেদি ভেঙে আকাঙ্ক্ষার দেহাবশেষ উদ্ধার হয়। জানা যায়, আমেরিকায় না যাওয়া নিয়ে গোলমালের সময়ে সে আকাঙ্ক্ষাকে শ্বাসরোধ করে খুন করে। তার পরে আকাঙ্ক্ষার ফোন থেকে তাঁর পরিবারকে মিথ্যা মেসেজ পাঠিয়ে যেত।
তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, নিজের বিলাসবহুল জীবনযাপনের খরচ জোগাতে বাধা হওয়ায় ২০১০ সালে ছত্তীসগঢ়ের রায়পুরে নিজের বাবা-মাকেও উদয়ন খুন করে বাগানের মাটিতে পুঁতে দিয়েছিল। উদ্ধার হয় দু’জনের কঙ্কাল।
তাই আকাঙ্ক্ষা-হত্যাকাণ্ডের রায় নিয়ে কৌতূহল ছিল অনেকের। এ দিন এজলাসে অনেকে ঢুকতে চাইলেও পুলিশ বাধা দেয়। ভিতরে শুধু দু’পক্ষের আইনজীবী, পুলিশকর্মীরা ছিলেন। আদালত কক্ষে সরকারি আইনজীবী অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য শুরুর পরেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা উদয়ন নিজের কথা বলতে থাকে। বক্তব্য থামাতে হয় অরুণবাবুকে। পরে অরুণবাবু উদয়নের সর্বোচ্চ শাস্তির আর্জি জানালেও বিচারক যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন। উদয়নের আইনজীবী অভিষেক বিশ্বাস জানান, উদয়নের শাস্তি কমানোর আর্জি নিয়ে উচ্চ আদালতে যাবেন।
রায়দানের পরে আদালত কক্ষ থেকে উদয়নকে বার করার সময় বাঁকুড়া ফাস্ট ট্র্যাক আদালতের দরজার সামনে সংবাদমাধ্যমের ভিড় ছিল। সেখানে হামলে পড়েন বেশ কিছু অতি উৎসাহী মানুষও। সেই জটলার সামনে দাঁড়িয়ে উদয়ন কিছু বলতে যায়। তখনই পুলিশকর্মীরা তাকে গাড়িতে তুলে দেন। পুলিশের গাড়ি কোর্ট লকআপের দিকে যাওয়ার পরে, পাতলা হয়ে যায় আদালত চত্বরের ভিড়।
বাঁকুড়া জেলা অ্যাডভোকেটস বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক রূপক ভট্টাচার্য বলেন, “এখন আদালত বসছে সীমিত সময়ের জন্য। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ভিড় কিছুটা কম। তবে উদয়নের মামলার রায়কে কেন্দ্র করে উৎসাহী হয়ে কিছু লোকজন বেশি এসেছিলেন।”