আকাঙ্ক্ষা শর্মা। ফাইল চিত্র
এ বাড়িতে ৫ জুন একটা অন্য রকম দিন। বাড়ির মেয়ের জন্মদিন। জ্বালানো হয় মোমবাতি। আকাঙ্ক্ষা শর্মা (২৮) আর নেই। তবু প্রতি বছর তাঁর জন্মদিনে উস্কে ওঠে স্মৃতি। এক দিকে, চলে আকাঙ্ক্ষার আত্মার শান্তি কামনা। অন্য দিকে, তাঁর খুনের বিচার প্রার্থনা।
বাঁকুড়া আদালত মঙ্গলবারই দোষী সাব্যস্ত করেছে আকাঙ্ক্ষা খুনে অভিযুক্ত উদয়ন দাসকে। বাঁকুড়া থেকে ২০১৮ সালে দুর্গাপুরে উঠে গিয়েছেন তাঁর পরিবারের সদস্যেরা। দুর্গাপুরের বাড়ি থেকে বাঁকুড়া আদালতের খবর শুনেছেন তাঁর বাবা, মা ও ভাই। আকাঙ্ক্ষার ভাই আয়ূষসত্যম শর্মা ফোনে বলেন, “বাড়ি ছাড়ার আগে দিদি আমাকে বলে গিয়েছিল, খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু সে যে আর আসবে না, এটা এখনও আমরা মেনে নিতে পারিনি। আজও দিদির জন্মদিনে বাড়িতে মোমবাতি জ্বালিয়ে ওর আত্মার শান্তি ও অপরাধীর শাস্তি চাই আমরা।” আকাঙ্ক্ষার বাবা শিবেন্দ্রনাথ শর্মা বলেন, “আমার স্ত্রী এখনও আকাঙ্ক্ষার কথা ভেবে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এখনও আমরা মানসিক ভাবে শক্ত হতে পারিনি। উদয়নের সর্বোচ্চ শাস্তিই আমাদের একমাত্র দাবি।”
২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ভোপালের গোবিন্দপুরা থানার সাকেতনগরে উদয়নের বাড়ি থেকে কার্যত সিমেন্টের মমি হয়ে যাওয়া আকাঙ্ক্ষার দেহাবশেষ উদ্ধারের পরেই আলোড়ন পড়েছিল। পুলিশ জেরায় জানতে পারে কেবল আকাঙ্ক্ষাকেই খুন নয়, উদয়ন খুন করে মাটিতে পুঁতে দিয়েছিল তার বাবা ও মাকেও। তাঁদের কঙ্কালও উদ্ধার হয়। পরপর তিনটি খুনের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরে উদয়নকে নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে।
উদয়ন নিজেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ বলে দাবি করলেও তদন্তে জানা যায় সে আদপে মাধ্যমিক পাশ। ফেসবুকে তার দশ-বারোটি ভুয়ো আইডি তদন্তকারীদের নজরে উঠে আসে। বাবা, মাকে খুন করার পরেও তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে যথারীতি টাকা তুলত উদয়ন। একটি মার্সিডিজ গাড়িও কেনে সে। টাকার জন্য বাবা, মায়ের জাল ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করে মোটা অঙ্কের টাকায় ছত্তীসগঢ়ের রায়পুরে তাঁদের নামে থাকা সম্পত্তি বিক্রি করে সে।
এতটা নৃশংস কাজ সে কী ভাবে করল, সে তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, ছোট থেকেই নিজের শারীরিক গঠন নিয়ে অবসাদে ভুগত উদয়ন। তার সহপাঠীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল না। বয়স বাড়লেও চাকরি না পাওয়ায় তার বাবা-মার সঙ্গে প্রায়ই কথা কাটাকাটি হত। তদন্তকারীদের একাংশের কথায়, নিজেকে সেরা প্রমাণ করতেই অপরাধের পথ বেছে নিয়েছিল সে। বিলাসবহুল জীবনযাপনের স্বপ্নও ছিল উদয়নের মধ্যে। বাঁকুড়া জেলা পুলিশ মহলের একাংশের মতে, আকাঙ্ক্ষা খুনের ঘটনায় সব থেকে চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল ভোপাল ও রায়পুর থেকে সাক্ষীদের বাঁকুড়া আদালতে আনা। এই খুনের তদন্তকারী অফিসার সাব ইনস্পেক্টর কৌশিক হাজরা একাধিক বার ভোপাল ও রায়পুরে গিয়ে সাক্ষীদের সঙ্গে কথা বলেন। সাকেতনগরের সিমেন্ট দোকানের মালিক, উদয়নের যে পড়শিরা তাকে আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে দেখেছিলেন, তাঁদের বাঁকুড়া আদালতে এনে সাক্ষী দেওয়ানো হয়। টানা প্রায় তিন বছর ধরে বিচারপর্ব চলার পরে, দোষী সাব্যস্ত হয় উদয়ন।
আকাঙ্ক্ষার ভাই মঙ্গলবার বলেন, “দিদি খুন হওয়ার পরে, বহু রাত আমরা ঘুমোতে পারিনি। উদয়ন দোষী সাব্যস্ত হয়েছে শোনার পরেও উৎকন্ঠা বেড়ে গিয়েছে। এ দিন রাতেও ঘুম আসবে না। কারণ, যার জন্য দিদিকে হারিয়েছি, তার চূড়ান্ত সাজা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের শান্তি ফিরবে না।”