ক্যানসারের রক্তচক্ষুকে হারিয়ে চনমনে খুদে

একরত্তি ছেলেকে পাঁজাকোলা করে ছুটতে ছুটতে আউটডোরে ঢুকেছিলেন বাবা। মাস কয়েকের ছেলেটার দুটো চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। রক্ত ঝরছে। বাবা ডুকরে কেঁদে বলেছিলেন, ‘‘দয়া করে আমার বাচ্চাটাকে বাঁচান!’’

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৪৪
Share:

সুস্থ হওয়ার পর চিকৎসক সোমা দে (বাঁ দিকে) এবং মায়ের সঙ্গে ছ’বছরের দেব। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

একরত্তি ছেলেকে পাঁজাকোলা করে ছুটতে ছুটতে আউটডোরে ঢুকেছিলেন বাবা। মাস কয়েকের ছেলেটার দুটো চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। রক্ত ঝরছে। বাবা ডুকরে কেঁদে বলেছিলেন, ‘‘দয়া করে আমার বাচ্চাটাকে বাঁচান!’’

Advertisement

ঠিক ছ’বছর পরের একটা সকাল। একটা দুরন্ত বাচ্চা ছুটতে ছুটতে ঢুকছে। শিশু ওয়ার্ডের শয্যার পাশে রাখা টেডি বিয়ারকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে। দুষ্টুমি মাখা দু’চোখে তাকিয়ে থাকছে ডাক্তার-নার্সদের দিকে। লেখাপড়ায় চৌখস। খেলাধুলোতেও তুখোড়। ‘ডক্টর আন্টি’ তাকে জড়িয়ে ধরে বলছেন, ‘‘পরের বার যখন ব্লাড টেস্ট করাতে আসবি, তখন তোর জন্য ছবির বই আর জলরং কিনে রাখব।’’ আহ্লাদে গলে যাচ্ছে ছেলেটা!

পাশাপাশি দু’টি ছবি। দু’টিই সত্যি!

Advertisement

২০১০ সালে দু’চোখে ক্যানসার ধরা পড়েছিল টালিগঞ্জের বাসিন্দা দেব সাউ-এর। রক্ত ঝরা দু’টি চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছিল। যন্ত্রণায় এক মুহূর্ত শুতে পারত না। মাঝেমধ্যেই বমি করত। ডাক্তাররা অনেকে কার্যত জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই শহরেই কয়েক বছর ধরে লাগাতার চিকিৎসার পরে দেব আজ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে। বছরে দু’বার শুধু ফলো আপ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসতে হয় তাকে। এ ছাড়াও মাঝেমধ্যে হাসপাতালে আসে সে— আত্মীয় হয়ে ওঠা ডাক্তার-নার্সদের সঙ্গে দেখা করতে!

কয়েক মাস বয়সে এই অবস্থায় হাসপাতালে এসেছিল দেব। নিজস্ব চিত্র।

ঠাকুরপুকুরের ক্যানসার হাসপাতালে যে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে দেবের চিকিৎসা হয়েছে, সেই সোমা দে জানান, রোগটার পোশাকি নাম বারকিটস লিম্ফোমা। এতে টিউমার খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। দেবের ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি শুরুর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে টিউমারের বৃদ্ধিতে রাশ টানা গিয়েছিল। আট মাস হাসপাতালে ভর্তি রেখে ওর চিকিৎসা চলেছিল। তার পর ২০১৩ সাল পর্যন্ত ‘মেনটেনান্স ট্রিটমেন্ট’ চলেছে। ‘‘এখন দেব পুরোপুরি ক্যানসার-মুক্ত,’’ বলেন তিনি। হাসপাতালের ডিরেক্টর অর্ণব গুপ্ত জানালেন, তাঁদের কাছে প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশু ক্যানসার রোগীর সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। তাড়াতাড়ি পৌঁছলে ভাল ফল পাওয়া সম্ভব।

একই কথা বলেছেন ক্যানসার চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বা সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ও। গৌতমবাবুর কথায়, ‘‘ক্যানসার মানেই সব শেষ, এই ধারণাটা থেকে বেরনোর সময় এসেছে।’’ কিন্তু এ বিষয়ে রোগীর পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকদের সচেতনতাও বাড়াটা জরুরি। সোমা যেমন বললেন, ‘‘এমনকী বহু ডাক্তারও ক্যানসারের প্রাথমিক উপসর্গগুলো জানেন না। বোঝেন না কোন পরিস্থিতিতে কোথায় রেফার করতে হবে।’’ ফলে এখনও বহু মানুষ ক্যানসার শুনলে চিকিৎসা ছেড়ে দিয়ে কবজ-তাবিজে ঝোঁকেন। সুবীরবাবু আশ্বাস দিচ্ছেন, ‘‘যদি চিকিৎসা সঠিক সময়ে শুরু হয় এবং পুরো মেয়াদ শেষ করা হয়, তবে একাধিক ক্যানসারের ক্ষেত্রে ভাল ফল মিলছে।’’ দৌড়ঝাঁপ করেও এক বিন্দু ক্লান্ত না হওয়া দেবকে দেখেই সেটা প্রমাণ হয়।

কথায় কথায় ছেলেটা জানাল, পড়াশোনা তার ভাল লাগে ঠিকই, কিন্তু খেলতে ভাল লাগে তার চেয়েও বেশি। কী খেলো? ‘‘দৌড়োদৌড়ি করি। ভূত-ভূত খেলি। কিন্তু আমি কখনও ভূত সাজি না।’’ কেন? ‘‘যে ভূত সাজে তার চোখে কাপড় বেঁধে রাখা হয়। সে তখন ভাল করে দেখতে পায় না। আমিও তো আগে চোখে দেখতে পেতাম না। আর ওটা চাই না। মিছিমিছি হলেও না।’’

ছেলেকে বুকে জড়িয়ে মা করবী সাউ বলেন, ‘‘এই বয়সেই কেমন বড়দের মতো কথা বলছে দেখছেন? অসুখটা ছেলেটাকে খুব তাড়াতাড়ি বড় করে দিল।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement