প্রতীকী ছবি।
কন্টক গাড়ি কমলসম পদতল/ মঞ্জীর চীরহি ঝাপি/ গাগরি বারি ঢারি করু পিছল/ চলতহি অঙ্গুলি চাপি…’।
সময়টা যদি ২০১৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরের পরে হত, তবে বেচারি রাধাকে আর কষ্ট করে কাঁটার উপর দিয়ে হাঁটা প্র্যাকটিস করতে হত না! তিনি মিস্টার আয়ান ঘোষকে বলেকয়েই দিব্যি জুতুয়া খটখটিয়ে, পায়ের নুপূর ঝমঝমিয়ে শ্রীহরির সঙ্গে কুঞ্জে দেখা করতে যেতে পারতেন। কিন্তু কথা হল, প্রেমে পায়ে কাঁটা বিঁধিয়ে, পা টিপে টিপে নৈঃশব্দ্য বজায় রাখার মধ্যে যে সুখ আছে, তা কি জুতোর হিলের প্রকাশ্য খটখটানিতে পাওয়া যাবে?
‘স্বামীর সম্পত্তি নয় স্ত্রী, তাই ৪৯৭ ধারা অসাংবিধানিক’— ২৭ সেপ্টেম্বরের এমনই যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করল সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চের বক্তব্য— কোনও আইন ব্যক্তির মর্যাদাকে খর্ব করতে পারে না। কারও যৌনতার অধিকারকে আইনি পরিসরে বেঁধে দেওয়া ঠিক নয়। তার ফলে বিগত একশো আটান্ন বছর ধরে চলে আসা এই ধারাটিকে খারিজ করল সুপ্রিম কোর্ট।
কিন্তু প্রশ্ন হল, এর পর কী হবে? এর আগেই-বা কী ছিল? এই ধারাটি ইংরেজ আমলে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পরকীয়া যে সেই কোন কাল থেকে অবাধে চলে আসছে! ইংরেজেরা যখন হামাগুড়ি দিচ্ছে, সেই আমল। অর্থাৎ, যখন মহাভারতের মতো মহাকাব্য লেখা হচ্ছিল, তখন থেকেই মানুষ পরকীয়ায় মজেছে! পুরাণে দেবরাজ ইন্দ্র থেকে চন্দ্রদেব অবধি কেউ বাকি নেই! বেচারি অহল্যা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। মহাভারতে যে চরিত্রটিকে প্রথমেই দেখা যায়—তিনি কুন্তী। পাণ্ডুর বিবাহিতা স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও অন্য পুরুষের সন্তান গর্ভে ধারণ করেছিলেন তিনি। মাদ্রীও তাই। অর্জুন-উলুপী, ভীম-হিড়িম্বা সম্পর্কগুলিকে পরকীয়া ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়! ইংরেজেরা যখন ভারতে আসেনি, তখন অনেক রাজা বহুবিবাহ তো করতেনই, সঙ্গে সুন্দরী দাসিদের ষোলো আনা পরকীয়া ছিল উপরি পাওনা। শাহেনশা, সুলতানেরা তো হারেম প্রায় ভরিয়েই ফেলেছিলেন! ইতিহাস বা পুরাণ যে দিকেই তাকাই না কেন, পরকীয়াই বিজয়কেতন তুলে চলেছে।
আর এক্ষেত্রে সবাইকে যিনি টেক্কা দিয়েছেন তিনি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। মজার কথা হল, যে প্রেমটি আজও প্রায় দৃষ্টান্তমূলক হয়ে আছে, সেই রাধা-কৃষ্ণের অবিনশ্বর প্রেমও কিন্তু আদতে পরকীয়াই! আর সেই পরকীয়া রাধাভাবেই কৃষ্ণপ্রেমে মজেছিলেন নদিয়ার চাঁদ— শ্রীচৈতন্য! দেহে পুরুষ, মনে রাধা। প্রেমের পাত্র সুলভ হলে ভাবের সম্যক স্ফূর্তি ও পরিণতি সম্ভব নয়। ভালবাসার মানুষকে যদি চাইলেই পাওয়া যায়, তবে তো মুশকিল! সর্ব ক্ষণই যদি একটি লোকের মুখ নাকের সামনে থাকে, তবে প্রেমের ব্যথা, বিরহ, বিচ্ছেদের যন্ত্রণা এবং রোমাঞ্চের রোমান্সটাই থাকে না। জীবন একঘেয়ে হয়ে দাঁড়ায়। তাই স্বকীয়া ও পরকীয়া প্রেমতত্ত্বে পরকীয়াই সর্বশ্রেষ্ঠ পদটি চিরদিন অর্জন করেছে। রুক্মিণী বা সত্যভামা নয়— আদর্শ প্রেমিকা শ্রীরাধিকা। সেই রাধিকাকেই প্রেমের আদর্শ করে নিজের মনে বসিয়ে নিয়েছিলেন শ্রীগৌরাঙ্গ। আর তাঁর সেই আকুলিবিকুলি প্রেমের জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল গোটা নবদ্বীপ ধাম! ভেসে গিয়েছিল আসমুদ্রহিমাচল ভারত। সহজিয়া বহিরঙ্গে, দেহসাধনার মাধ্যমে যে জটিল ও সমৃদ্ধ দর্শন চৈতন্যদেবের সময়ে পূর্ণাঙ্গ বিকাশ লাভ করেছিল, তার বানভাসিতে, সেই প্রেমের তরঙ্গে ৪৯৭ ধারা একটি সুঁতিখালও নয়!
৪৯৭ ধারা যখন ছিল না তখনও পরকীয়া ছিল। যখন ছিল, তখনও পরকীয়া চলছিল। যখন নেই, তখন তো আর কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
ওই ধারা নেহাতই ধোঁকার টাটি! কারণ, আমাদের চিরাচরিত সোশ্যাল ট্যাবু। ‘যদিদং হৃদয়ং মম’ বললেই যেন হৃদয়ের উপর একচেটিয়া দখলদারি হয়ে যায়! আমরা জেনেও ভুলে যাই, হৃদয়টা জমি নয় যে, একটা সাইনবোর্ড গেঁড়ে দিলেই মালিকের দখলে চলে এল। অথবা, ভালবাসা কোনও সরলরেখা নয়, যে সব সময় একমুখীই থাকতে হবে! তাই স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের সচেতন মন ভয়ঙ্কর আদর্শবাদী হয়ে একাধারে পরকীয়াকে ‘ছ্যা ছ্যা, তোবা তোবা’ বলে আর অবচেতনে ‘চুপি চুপি কারচুপি’ কেস করার জন্য ব্যস্ত হয়। তাই যখন ৪৯৭ ধারা ছিল, তখনও পরকীয়া ছিল, আজও আছে, এবং ভবিষ্যতে তো অমোঘ ভাবে থাকবেই।
তবে ভাবার বিষয় একটাই। পরকীয়া বৈধ হলে কোন বাঘটা মারা যাবে! পরকীয়া আর অপরাধ নয় ভেবে কি কোনও স্বামী তাঁর স্ত্রীকে ডেকে বলতে পারবেন— ‘ওগো শুনছ, আমি একটু পরকীয়া করতে যাচ্ছি!’ অথবা, কোনও স্ত্রী প্রেমিককে বগলদাবা করে স্বামীর চোখের সামনে দিয়ে শয়নকক্ষে চলে যেতে পারবেন?
উত্তর একটাই— না! পরকীয়া যেমন ছিল, তেমনই থাকবে। তার গোপনীয়তা, তার রোমাঞ্চ, তার নিষিদ্ধ হাতছানিই প্রেমে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পেয়েছে। প্রকাশ্যে পরকীয়া হলে, সে আবার পরকীয়া কিসের! রাধা ড্যাংড্যাং করে কৃষ্ণের সঙ্গে ‘হনিমুন’ করতে গেলে জ্ঞানদাস কি লিখতে পারতেন— ‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে, গুণে মন ভোর। প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।’! এই হাহাকারই তো পরকীয়ার আসল আকর্ষণ!
সুতরাং, আইন থাকলেও যে গোপনীয়তা ছিল, আইন না থাকলেও সেই একই গোপনীয়তা বজায় রাখতেই হবে। কারণ, লোকনিন্দা, কলঙ্ক— এ সব ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের ধারা মানে না!
সব শেষে, একটা কথা মনে রাখতে হবে। পরকীয়ার টক-মিষ্টি স্বাদ ভাল ঠিকই। কিন্তু যখনই অপরাধের প্রসঙ্গ ওঠে, তখনই দেখা যায় যে পরকীয়া-ঘটিত খুনের সংখ্যা সব চেয়ে বেশি। সত্যি কথা বলতে, ৪৯৭ ধারায় এ যাবৎ ঠিক কত জন শাস্তি পেয়েছেন? বরং তার চেয়ে বেশি মানুষ শাস্তি পেয়েছেন, নিজের স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক বা প্রেমিকার হাতে প্রতিহিংসার শিকার হয়ে। অকালে প্রাণ দিয়ে! যারা পরকীয়া প্রেম বৈধ হল ভেবে উল্লসিত, পাশাপাশি, তাদের আরেকটি বাস্তব সত্যও মনে রাখা প্রয়োজন। ৪৯৭ ধারা বাতিল হলেও দফা তিনশো দুইয়ের প্যাঁচ আজও আছে! ওটা বাতিল হয়নি।
লেখক সাহিত্যিক