১৯৯৬ সালে এই রেলসেতুর জন্য লড়াই শুরু করেছিলেন অধীররঞ্জন চৌধুরী। —ফাইল ছবি।
কখনও তিনি বিধায়ক, কখনও সাংসদ, কখনও রেলের রাষ্ট্রমন্ত্রী, কখনও লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা এবং পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান। তার মধ্যে কেটে গিয়েছে ২৮টি বছর। কিন্তু তিনি নসিপুর থেকে আজিমগঞ্জ— ভাগীরথী নদীর উপর সাড়ে চার কিলোমিটার রেলসেতুর কথা ভোলেননি।
ব্রিটিশ আমলের পর যে রেলপথ উঠে গিয়েছিল, তা নতুন করে পত্তন করতে দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। শুরু হয়েছিল কংগ্রেসের লোকসভা সাংসদ মনোরঞ্জন ভক্তকে দিয়ে। তার পরে ওই সাড়ে চার কিলোমিটার তাঁকে নিয়ে গিয়েছে কোন কোন দরজায়! কখনও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী, কখনও যোজনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান কেসি পন্থ, কখনও রেলমন্ত্রী নীতীশ কুমার, কখনও প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়, কখনও রেলমন্ত্রী লালু প্রসাদ, কখনও কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী (লালুর দলের) প্রেমচাঁদ গুপ্ত আবার কখনও অশ্বিনী বৈষ্ণো।
মুর্শিদাবাদের নবগ্রামের বিধায়ক থাকাকালীন ১৯৯৬ সালে যে লড়াই শুরু করেছিলেন তিনি, ২০২৪ সালে সেই কাজ সম্পন্ন হল! কিন্তু নিয়তির পরিহাসে তখন তিনি আর জনপ্রতিনিধি নন। বহরমপুর লোকসভায় হেরে গিয়েছেন অধীররঞ্জন চৌধুরী। কিন্তু তাতে তাঁর টানা ২৮ বছরের নাছোড়বান্দা দৌড় মিথ্যা হয়ে যায়নি। বরং ‘কাহিনি’ হয়ে উঠেছে। আমলাতন্ত্রের পাহাড় ভাঙার কাহিনি।
ভাগীরথী নদীর উপর রেলসেতুর ব্যবহার স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ক্রমশ কালের নিয়মে তা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। সাক্ষী হিসাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল কয়েকটি স্তম্ভ। নবগ্রামের বিধায়ক থাকার সময় অধীরের কাছে রেলযাত্রী সংগঠনের তরফে জনৈক এআর খান নতুন করে সেতুটি নির্মাণের আর্জি জানান। ঘটনাচক্রে, আজিমগঞ্জ নবগ্রাম বিধানসভার অন্তর্গত। কিন্তু বিধায়ক আর কী করে রেলের পরিকাঠামো নির্মাণ করেন! বড়জোর দৌত্য করতে পারেন। অধীর সেটাই শুরু করেন। ১৯৯৬-’৯৭ সাল। আন্দামানের কংগ্রেস সাংসদ মনোরঞ্জন ভক্ত তখন রেলের কনভেনশন কমিটির চেয়ারম্যান। মনোরঞ্জনের কাছে অধীরের আর্জি ছিল, কমিটি যেন একটি বার মুর্শিদাবাদের ওই এলাকায় যায়। তা হলে অন্তত রেলের খাতায় বিষয়টা নথিভুক্ত হবে। মনোরঞ্জনের নেতৃত্বে কমিটি যায়। ঘুরে দেখে রিপোর্টও দেয়। ওইটুকুই।
১৯৯৯ সালে বহরমপুরের সাংসদ হন অধীর। তখন আডবাণী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর কাছে গিয়ে অধীর আর্জি জানান নসিপুর-আজিমগঞ্জ রেলসেতু নির্মাণে উদ্যোগী হতে। আডবাণী পাল্টা প্রশ্ন করেন, তিনি তো রেলমন্ত্রী নন! তিনি কী করে রেলসেতু বানাবেন? তখন বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার সরকার। সংসদে রোজ কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, ভারতকে বিপাকে ফেলার জন্য পাকিস্তান বাংলাদেশে ‘অস্থিরতা’ তৈরি করতে চাইছে। কেন্দ্রের সেই ভাষ্য ‘হাতিয়ার’ করে অধীর জবাব দেন, বাংলাদেশ সীমান্তে কোনও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটলে দ্রুত সেনা পাঠাতে সুবিধা হবে ওই রেলসেতু থাকলে। আডবাণী পরামর্শ দেন যোজনা কমিশন থেকে তথ্য জোগাড় করার।
ব্রিটিশ আমলে যে ওই রেলসেতুর অস্তিত্ব ছিল, সে তথ্য খুঁজতে শুরু করেন অধীর। যোজনা কমিশনের পরিবহণ বিভাগের এক বাঙালি আধিকারিককে অনুরোধ করে তা পেয়েও যান। তথ্য নিয়ে পৌঁছন যোজনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান কেসি পন্থের কাছে। তখন যে কোনও কেন্দ্রীয় প্রকল্পের জন্য কমিশনের অনুমোদন প্রয়োজনীয় ছিল। তখন রেলমন্ত্রী নীতীশ কুমার। তাঁকে অধীর বোঝান যোগাযোগ ব্যবস্থা, পর্যটন, কৃষির উন্নতি কতটা নির্ভরশীল ওই সাড়ে চার কিলোমিটার রেলসেতুর উপর। নীতীশ পরামর্শ দেন, যোজনা কমিশনের সবুজ সঙ্কেত নিয়ে আসতে। আবার পন্থের হাতে-পায়ে ধরাধরি!
কিন্তু লাভ হয়নি। তার মধ্যে বেশ কয়েক বার প্রণবের কাছেও দরবার করেছিলেন অধীর। তাতেও কাজ হয়নি। অতঃপর ২০০৪ সালে জঙ্গিপুরে লোকসভা ভোটে দাঁড়ান প্রণব। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সেই প্রথম জনগণের ভোটে জিতে সংসদে যাওয়া। প্রণবকে কার্যত কাঁধে নিয়ে বৈতরণী পার করিয়েছিলেন অধীর। মনমোহন সিংহের ইউপিএ সরকারে প্রণব হন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। রেলমন্ত্রী লালু।
অধীরের ভিতরে আবার নড়তে শুরু করে রেলসেতুর ভূত। প্রথমে লালুর কাছে গিয়ে আর্জি। লালু অরাজি নন। কিন্তু জানান, মুর্শিদাবাদে রেলব্রিজের পাল্টা পটনায় সেনা ক্যান্টনমেন্ট তৈরির বন্দোবস্ত করার কথা প্রণবকে বলতে হবে অধীরকে। তা-ই সই। অধীর প্রণবকে গিয়ে জানালেন লালুর শর্তের কথা।
রেল বাজেট পেশ হল। কিন্তু তাতে নসিপুর-আজিমগঞ্জের কথা নেই। কিন্তু অধীর তো নাছোড়! তিনি গিয়ে ধরলেন লালুরই দলের নেতা এবং কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী প্রেমচাঁদকে। প্রণবকে আবার অনুরোধ করলেন প্রেমচাঁদকে বিষয়টা একটু বলে দেওয়ার জন্য। বলেছিলেন প্রণব। রেল বাজেটের জবাবি বক্তৃতায় যুক্ত হয়েছিল নসিপুর-আজিমগঞ্জ রেলসেতু প্রকল্প। বরাদ্দ ৮০ কোটি টাকা। ২০০৬ সালে প্রণব, লালু, অধীর একসঙ্গে ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেন সেই রেলসেতুর। ভেবেছিলেন, এ বার অবশেষে জট কাটল।
জট কাটেনি। কারণ, সেতু তৈরির জন্য জমি দরকার। কেন্দ্র থেকে টাকা চলে এল জেলাশাসকের কাছে। কিন্তু জমি নিতে গিয়ে গোলযোগ। অধীর-ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, এলাকার সিপিএম জমির মালিকদের উস্কে দিয়েছিল। তখন সিঙ্গুর আন্দোলন শুরু হয়েছে। দাবি ওঠে, জমির বদলে চাকরি চাই। ভাগীরথীর পূর্ব পারের সমস্যা মিটলেও পশ্চিম পারে জট জটিল হয়ে ওঠে। তার মধ্যে দ্বিতীয় ইউপিএ জমানায় অধীর নিজেই হলেন রেলের প্রতিমন্ত্রী। কিন্তু তাতেও ফল হয়নি। চাকরি নিয়ে জমির মালিকদের আশ্বস্ত করেছিলেন বটে। কিন্তু রাতারাতি জমি টুকরোয় টুকরোয় ভাগ করে মালিকানা বণ্টিত হয়ে যায়। বেড়ে যায় চাকরি পাওয়ার দাবিদারের সংখ্যা। রেল তাতে অনুমোদন দেয়নি।
কংগ্রেস কেন্দ্রে ক্ষমতা হারায়, অধীর হারান রেল মন্ত্রক। ক্ষমতায় আসে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। দ্বিতীয় মোদী সরকারের সময়ে অধীর ছিলেন পিএসি চেয়ারম্যান। যে পদের মর্যাদা কেন্দ্রীয় পূর্ণমন্ত্রীর সমান। পদাধিকার বলে রেলের কর্তাদের ডেকে সাড়ে চার কিলোমিটার রেলসেতু নির্মাণের জটিলতা কাটাতে উদ্যোগী হন বহরমপুরের সাংসদ। দেখা করেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণোর সঙ্গেও।
বাকিটা ঠিকঠাক। জটিলতা কাটে। শেষ হয় আজিমগঞ্জ-নসিপুর রেলসেতু নির্মাণের কাজ। মাঝখানে কেটে গিয়েছে ২৮টি বছর। রয়েছে ছয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, যোজনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান, অজস্র আমলার কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকার ইতিহাস। রয়েছে এক রাজনীতিকের নাছোড়বান্দা মনোভাব, জেদ আর অধ্যবসায়।
অবশ্য ‘কাহিনি’ তো এ ভাবেই তৈরি হয়!