উচ্চ মাধ্যমিকে সাফল্যের স্বাদ এসেছিল শুক্রবার সকালে। সেই আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতেই কৃতী এক ছাত্রীর ভবিষ্যতের সামনে পড়ে গেল প্রশ্নচিহ্ন। শুক্রবার রাতে ঘুমনোর সময় অ্যাসিড হামলা হয়েছে দাসপুরের নন্দনপুরের ওই তরুণীর উপর। অভিযোগ, বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় প্রতিবেশী যুবকই এই কাণ্ড করেছে। ঘটনায় দু’জনকে আটক করেছে পুলিশ। ওই তরুণী ভর্তি কলকাতার এমআর বাঙুর হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর ডান চোখ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, সোনা গলানোর কাজে ব্যবহৃত সালফিউরিক অ্যাসিড দিয়েই হামলা হয়েছে। যে দু’জনকে পুলিশ আটক করেছে, তাদের মধ্যে স্থানীয় বালকরাউত গ্রামের যুবক রাধামোহন দিন্দা সোনার গয়নার কারিগর। ফলে, অ্যাসিড জোগাড়ে তাকে বেগ পেতে হয়নি। আটক হওয়া আর এক যুবক হল নন্দনপুরেরই বিশ্বজিৎ সামুই। অভিযোগ, রাধামোহন ওই ছাত্রীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মেয়েটি রাজি হননি। দিন পনেরো আগে অন্যত্র বিয়ে হয় রাধামোহনের। পুরনো আক্রোশ থেকেই ওই যুবক অ্যাসিড হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ। পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ বলেন, “আটক দু’জনকে জেরা করা হচ্ছে। কী অ্যাসিড, কোথা থেকে আনা হয়েছিল, ঠিক কী কারণে হামলা চলল— সবই জানার চেষ্টা চলছে। ”
এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে কলা বিভাগে ৪০১ নম্বর (৮০ শতাংশ) পেয়েছেন নন্দনপুর হাইস্কুলের ওই ছাত্রী। শুক্রবার ফল জানার পরে বাবা, মা আর ভাইকে তিনি জানিয়েছিলেন, ঘাটাল কলেজে বাংলায় স্নাতক পড়বেন। কিন্তু শুক্রবার রাতের ঘটনায় সব তছনছ হয়ে গিয়েছে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, শুক্রবার রাতে মাটির বাড়িতে বাবা, মা, ভাইয়ের সঙ্গে ঘুমোচ্ছিলেন ওই তরুণী। গরমে ঘরের দরজা ছিল খোলা। অভিযোগ, রাত আড়াইটে নাগাদ রাধামোহন ঘরে ঢুকে তরুণীর গায়ে অ্যাসিড ঢেলে দেয়। জখম হন তরুণীর ভাই এবং মা-ও।
যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে প্রথমে বাড়ির কাছেই পুকুরে নেমে পড়েন ওই ছাত্রী। তারপর তাঁকে ঘাটাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে স্থানান্তরিত করা হয় কলকাতায়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ওই তরুণীর শরীরের প্রায় ৩০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছে। সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মুখ, চোখ, গলা ও হাত। তরুণীর ভাইকেও এমআর বাঙুরে ভর্তি করানো হয়েছে। বছর বারোর ওই কিশোরের হাত পুড়েছে।
দাসপুর ১ ও ২ ব্লকের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই সোনার গয়না তৈরির কাজ হয়। এখানকার বহু কারিগর সুরাত, মুম্বইতেও কাজ করেন। ফলে, এলাকার ছোটখাট সোনার দোকানে সালফিউরিক অ্যাসিড থাকেই। কত পরিমাণ সোনা গলানোর জন্য ঠিক কতটা অ্যাসিড কেনা হল, একটি দোকানে কত পরিমাণ অ্যাসিড মজুত রয়েছে নথি-সহ এ সব হিসেব এক জন কারিগরের কাছে থাকার কথা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা থাকে না বলে অভিযোগ। পুলিশ-প্রশাসনের এ ক্ষেত্রে যে নজরদারি চালানোর কথা, তা-ও ঠিকমতো হয় না বলে অভিযোগ। যদিও পুলিশ সুপার ভারতীদেবীর দাবি, ‘‘নজরদারি চলেই। এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।’’
এ দিকে, গ্রামের কৃতী ছাত্রীর এমন পরিণতি মানতে পারছে না নন্দনপুর। হতবাক তরুণীর স্কুলের বন্ধুবান্ধবরাও। তাঁর এক সহপাঠী বলেন, “প্রথম শ্রেণি থেকে আমরা একসঙ্গে পড়েছি। শুক্রবারও এক সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট আনতে গিয়েছিলাম। কোত্থেকে যে কী হয়ে গেল।” নন্দনপুর হাইস্কুলের শিক্ষক মলয় সাহারও বক্তব্য, “বরাবরই পড়াশোনায় ভাল ছিল ওই ছাত্রী। ওর জীবনে কেন এমন ঘটল, বুঝতে পারছি না।”
এম আর বাঙুর হাসপাতাল সূত্রের খবর, জ্ঞান ফেরার পর থেকে ওই ছাত্রীও বিলাপ করে চলেছেন। একটিই কথা, ‘‘আমি তো কারও ক্ষতি করিনি। তবে কেন আমার সঙ্গে এমন হল!’’