প্রায় সাড়ে ৯ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। নিজস্ব চিত্র।
কুন্তল ঘোষের চিঠি সংক্রান্ত মামলায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তলব করেছিল সিবিআই। সেই মতো শনিবার নিজ়াম প্যালেসে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দফতরে প্রায় সাড়ে ৯ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। জিজ্ঞাসাবাদের পর বাইরে বেরিয়ে অভিষেক বলেন, ‘‘জিজ্ঞাসাবাদের নির্যাস শূন্য। একটা আস্ত অশ্বডিম্ব। যেটা আমি গতকালই বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম, আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ থাকলে জনসমক্ষে আনা হোক। জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন নেই। প্রমাণ থাকলে ফাঁসির মঞ্চে উঠব। আমারও সময় নষ্ট, তদন্তকারীদের সময় নষ্ট।’’
শনিবার সকাল ১০টা ৫৮ মিনিটে নি়জ়াম প্যালেসে পৌঁছন অভিষেক। এর পর রাত ৮টা ৩৭ মিনিটে সেখান থেকে বেরোন তৃণমূল সাংসদ। বেরিয়ে তিনি বলেন, ‘‘নবজোয়ার রুখতেই নোটিস পাঠানো হচ্ছে। আমাকে ডাকাডাকি বন্ধ করুন। আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ থাকলে আমায় গ্রেফতার করুন। কেউ তো আটকাচ্ছে না। ইডি, সিবিআই, এনআইএ, এজেন্সিকে দিয়ে ধমকানো হচ্ছে। আমরা বশ্যতা স্বীকার করব না। তদন্তের নাম করে জনসংযোগ যাত্রা রোখার সুপরিকল্পিত চক্রান্ত।’’
বিচারপতি অমৃতা সিন্হা নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ধৃত কুন্তলের চিঠির প্রেক্ষিতে যে নির্দেশ দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে কলকাতা হাই কোর্টে দ্রুত শুনানির আর্জি জানিয়েছিলেন অভিষেকের আইনজীবীরা। তা সম্ভব হয়নি। শুক্রবার সিবিআই নোটিস পেয়ে অভিষেককে দলের নবজোয়ার কর্মসূচি মাঝপথে স্থগিত করে বাঁকুড়া থেকে ফিরে আসতে হয়। সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়ার পর সাংসদ বলেন, ‘‘আমার দায়বদ্ধতা মানুষের কাছে। মাথানত করলে ঈশ্বরের কাছে করব। জনতা জনার্দনের কাছে করব। দিল্লির শক্তির কাছে করব না।’’ অভিষেকের দাবি, তিনি তৃণমূল করেন বলেই তাঁকে সিবিআই তলব করেছে। তিনি যদি বিজেপিতে থাকতেন, তাঁকে ডাকা হত না। তিনি বলেন, ‘‘দিল্লির পোষা কুকুর হয়ে থাকব না।’’ নাম না করে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে নিশানা করেছেন অভিষেক। বলেছেন, ‘‘আমায় একটা তালিকা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, এঁদের চেনেন? বিশ্বাস করবেন না, ৯০ শতাংশের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুর আর মুর্শিদাবাদ। সেখানে দলের তরফে কে দায়িত্বে ছিলেন? তাঁকে জিজ্ঞাসবাদ করা হবে না কেন? আমাদের থেকে যা জানতে চাওয়া হয়, দিয়েছি। অধিকাংশ প্রশ্নই বোগাস।’’
অভিষেকের অভিযোগ, বিজেপির অনেক নেতা দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের ডাকা হয় না। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘‘সব ক’টা চোর বিজেপির সদস্য। বিজেপি কোনও দুর্নীতিগ্রস্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে ? পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে তৃণমূল। শুভেন্দুকে নারদকাণ্ডে টাকা নিতে দেখা গিয়েছে, ওঁকে সাসপেন্ড করেছে ? চিঠির ভিত্তিতে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সুদীপ্ত সেনের চিঠির ভিত্তিতে কেন শুভেন্দুকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে না ? অমিত শাহ নিজে বলেছিলেন, তাঁকে মোদীর নাম বলতে চাপ দিয়েছিল সিবিআই। এর জন্য অমিত শাহকে ডেকেছে সিবিআই? দিল্লির গা-জোয়ারি বরদাস্ত করব না। সিবিআইয়ের কাছে কি নারদার ফুটেজ নেই ? তাও শুভেন্দু অধিকারীকে ডাকছে না কেন ? এই জন্যই সিবিআইয়ের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘শুভেন্দুর বিরুদ্ধে প্রমাণ রয়েছে, তাও তাঁকে ডাকছে না। প্রসন্নর বাড়িতে দিলীপের দলিল মিলেছে, তাঁকেও ডাকেনি সিবিআই। বিজেপির জন্য এক আইন, আমার জন্য আরেক আইন। কংগ্রেসও এজেন্সিকে ব্যবহার করেছে। আমার যা বলার সিবিআইকে বলে এসেছি।’’
অভিষেকের হুঁশিয়ারি, ‘‘আমি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার হয়েই থাকব। নবজোয়ায়ের সাফল্য দেখেই এসব করছে। রাজনৈতিক ভাবে লড়তে না পেরে ইডি-সিবিআইকে লেলিয়ে দিয়েছে। আমি প্রাইম টার্গেট, তাও আমি থামব না। নবজোয়ারকে জনজোয়ারে পরিণত করব।’’
হাজিরার আগে সিবিআইকে চিঠি
শনিবার সকাল ১১টায় অভিষেককে তলব করা হয়েছিল। সেই মতো সকাল ১০টা ৫২ মিনিটে কালীঘাটের বাড়ি থেকে রওনা দেন অভিষেক। সকাল ১০টা ৫৮ মিনিটে নিজাম প্যালেসে পৌঁছন তৃণমূল সাংসদ। তার আগে কেন্দ্রীয় সংস্থাকে অভিষেক চিঠি দেন। জানান, কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তিনি সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছেন। ২২ মে, সোমবার, শীর্ষ আদালতে তাঁর মামলার দ্রুত শুনানির আর্জিও জানানো হবে। কুন্তল ঘোষের চিঠি সংক্রান্ত মামলার প্রেক্ষিতে হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় প্রথমে জানিয়েছিলেন, নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডের তদন্তের প্রয়োজনে অভিষেককে ইডি এবং সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে যান অভিষেক। শীর্ষ আদালত মামলার বেঞ্চ বদলে দেয়। মামলাটি যায় বিচারপতি অমৃতা সিন্হার বেঞ্চে। তিনিও একই কথা বলেন। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশই বহাল রাখেন বিচারপতি সিন্হা। এর পর সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শুক্রবার ডিভিশন বেঞ্চে দ্রুত শুনানির আর্জি জানান অভিষেক। কিন্তু ডিভিশন বেঞ্চ দ্রুত শুনানির আর্জি খারিজ করে দেয়। অভিষেক আবার হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে মামলার দ্রুত শুনানির জন্য আবেদন করেন। কিন্তু সেখানেও আবেদন গ্রাহ্য হয়নি। তার পরেই শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হন অভিষেক।
সকাল থেকেই সক্রিয় ইডি
নিজার প্যালেসে অভিষেক হাজিরা দেওয়ার আগেই শনিবার কলকাতা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার একাধিক ঠিকানায় তল্লাশি অভিযান শুরু করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। দক্ষিণ কলকাতা এলাকায় অভিষেকের বাড়ি। আর দক্ষিণ ২৪ পরগনায় তাঁর লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবার। শনিবার ইডির প্রথম ‘নিশানা’য় ছিলেন অভিষেকের দফতরের প্রাক্তন কর্মী সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র (যিনি ‘কালীঘাটের কাকু’ বলেই সমধিক পরিচিত)। বেহালার ফকিরপাড়া রোডে সুজয়ের ফ্ল্যাট, বাড়ি, অফিস-সহ একাধিক ঠিকানায় শনিবার সকাল থেকেই তল্লাশি অভিযান শুরু করে ইডির তদন্তকারী দল। পাশাপাশিই শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব। ইডির নিশানায় শনিবার ছিল অভিষেকের লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বিষ্ণুপুর বিধানসভা এলাকার বিবিরহাটও। সেখানকার জেলা পরিষদ আসনের তৃণমূল সদস্য জ্ঞানানন্দ সামন্তের বাড়িতে ইডির তল্লাশি শুরু হয়। ইডির অন্য দু’টি দলও ওই এলাকায় ছিল বলে সূত্রের খবর। বিষ্ণুপুরের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী দিলীপ মণ্ডলের পরিচিতি রয়েছে ‘অভিষেক ঘনিষ্ঠ’ হিসাবে।
‘এজেন্সিরাজ’ টুইট মমতার
২০১১ সালের ২০ মে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ১২ বছর আগে এই তারিখেই শপথ নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার সেই দিনটিকে স্মরণ করে টুইটে রাজ্যের মানুষকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে আক্রমণ করেন মমতা। ঘটনাক্রমে, তৃণমূলনেত্রী যখন এই টুইট করেছেন, তখন সিবিআই-জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছেন তাঁর দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক। টুইটে মমতা লেখেন, ‘‘২০০১ সালে এই দিনে আমরা ৩৪ বছরের দানব শাসনকে উৎখাত করে পশ্চিমবঙ্গে মা-মাটি-মানুষের সরকার গঠনের শপথ নিয়েছিলাম। সেই অঙ্গীকারের আজ পুনর্নবীকরণ করছি এবং জনগণের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করছি।’’ এর পরেই ‘অসুবিধার’ কথা বলেন মমতা। লেখেন, ‘‘কেন্দ্রে স্বৈরাচারী সরকারের এজেন্সি-রাজ আমাদের কাজকে চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে। কিন্তু সারা দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেন। মিছিলে আছেন। দীর্ঘজীবী হোক ২০ মে।’’
রাতেই মমতার বাড়িতে অভিষেক
দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পর সিবিআই দফতর থেকে বেরিয়েই পূর্ণ উদ্যমে দলীয় কর্মসূচিতে ‘ঝাঁপিয়ে পড়া’র কথা বললেন অভিষেক। তিনি বলেন, “পরশু দিন থেকে দশ গুণ বেশি উৎসাহ নিয়ে জনসংযোগ যাত্রা করব।” দীর্ঘ দু’মাসের কর্মসূচির ধকল না নেওয়ার জন্য যে অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন, সে কথা জানিয়ে অভিষেক বলেন, “মা, বাবা, দলনেত্রী বারণ করেছেন, জ্বর, গলাব্যথা হয়েছে, হাত কেটে গিয়েছে, তবু ফিরিনি। সিবিআইয়ের জন্য ফিরতে হল।” শনিবার রাতে নিজাম প্যালেস থেকে বেরিয়ে সোজা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালীঘাটের বাড়িতে যান অভিষেক। দেখা করেন তাঁর সঙ্গে।
অভিষেককে নিয়ে শুভেন্দু-সুকান্ত
অভিষেককে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে শুভেন্দু বলেন, ‘‘আমার ভাইকেও চার বার ১০ ঘণ্টা করে জেরার নামে হেনস্থা করা হয়েছিল। লোকের খারাপ করলে নিজের খারাপ হয়। এই কথাটা যেন উনি মনে রাখেন।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘‘সবুরে মেওয়া ফলে। ওঁর যাতে আর সময় নষ্ট না হয়, তার ব্যবস্থা খুব দ্রুত হবে।’’